অর্থনীতি ডেস্কঃ
পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য। বহুকাল থেকে বাংলার কৃষকেরা পাটের চাষাবাদ করছেন। পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। অর্থকরী এ ফসলটি যুগে যুগে সারা বিশ্বে দেশের জন্য বয়ে এনেছে সুনাম ও খ্যাতি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, জমি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে পাট উৎপাদনে অধিক উপযোগী। বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে পাটচাষি রয়েছে ৪০ লাখ। মোট শ্রমশক্তির ১২ শতাংশ মানুষ পাট উৎপাদনের কাজে জড়িত। ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য দেশের দ্বিতীয় রপ্তানি খাত হিসেবে স্থান দখল করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের কাঁচা পাট রপ্তানি করা হয় ভারত, চীন, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ আরও অনেক দেশে। জিডিপিতে পাটের অবদান ০.২৬ এবং কৃষি খাতে অবদান ১.১৪ শতাংশ। আমাদের দেশের উৎপাদিত পাট গুণে-মানে অন্যান্য দেশের চেয়ে অধিক উন্নত। পাটশিল্প একসময় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত ছিল। যার আয়ও ছিল অন্যান্য খাতের চেয়ে সবার শীর্ষে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটের কারখানা আদমজী জুটমিল আমাদের দেশে অবস্থিত। যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। নানা কারণে পাটশিল্পের গৌরবময় অবস্থা কিছুটা ধূসর হলেও নতুন করে আশা জেগে উঠেছে এ শিল্পে।
প্রতি বছর পৃথিবীতে এক ট্রিলিয়ন টনের বেশি পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে বিশ্ব পরিবেশ এখন হুমকির মুখে। পরিবেশ রক্ষায় বিশেষজ্ঞগণ পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছেন। ইউরোপসহ বেশ কিছু দেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাট সহজেই পচনশীল হওয়ায় প্লাস্টিক আর পলিথিন আগ্রাসনের এই বিরূপ সময়ে সোনালি আঁশ দেখাচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। বর্তমানে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারে অধিক মনোযোগ দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্ব বাজারে পাটের স্থান সহজেই দখল করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল মোটরগাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামো নির্মাণে পাটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য, কম্পিউটারের বডি, বিমানের পার্টস, খেলাধুলার সামগ্রী তৈরিতে বাংলাদেশের উন্নতমানের পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। পাটের রুপালি কাঠি বা সোলার চাহিদাও রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। পাটকাঠি জ্বালানির চারকোল দিয়ে ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি, কার্বন পেপার, লিথিয়াম ব্যাটারি, আতশবাজি তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্লাস্টিকজাত পণ্য এড়াতে ও পরিবেশ রক্ষায় পাটের ব্যাগ ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের সমীক্ষা অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন পাটের থলে বা ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এই কথা মাথায় রেখে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ আরও বেশি রপ্তানি করতে পারলে আমরা সহজেই পাটের মাধ্যমে বিশ্ব বাজার ধরতে পারব।
পাট এমন একটি আদর্শ পণ্য যার কোনো কিছুই ফেলনা নয়। আমরা যদি পাটের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি একদিন এই পাট হতে পারে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন এবং দিন বদলের জাদুর কাঠি। পাটের শুকনো পাতার তৈরি চা ইতিমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। এছাড়া পাট থেকে তৈরি জামাকাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, ফতোয়া, নারী-পুরুষের স্যান্ডেল, বাস্কেট, ম্যাটস, স্যুট, সুয়েটার, জুট ডেনিম, শিকা, কার্পেট, শোপিচ, সুতাসহ অন্যান্য পাটজাত দ্রব্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে বাংলাদেশের তৈরি ২৮২টি পাটজাত পণ্য গৌরবের সঙ্গে রপ্তানি করা হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ লাখ ডলার মূল্যের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি করা হয়েছে যা বিগত অর্থবছরের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি। দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের পরেই পাট অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ খাতটি আরও এগিয়ে যাবে। পাটের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত, ঘাম আর স্বপ্ন। পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তা দেশের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করে দেশের জন্য বয়ে আনবে সম্মান ও বৈদেশিক মুদ্রা।
Leave a Reply