ইসলামিক ডেস্কঃ
সবচেয়ে নিকৃষ্ট আবাসস্থল হলো জাহান্নাম। আর সর্বোত্তম আবাসন হলো চির সুখের স্থান জান্নাত। কে কোন আবাসের মালিক হবে নির্ভর করবে দুনিয়ায় মানুষের বিশ্বাস ও কর্মপন্থার ওপর। তবে মানুষমাত্রই প্রত্যাশা করে, উত্তম আবাসস্থল অর্থাৎ বেহেশত পাওয়ার। কিন্তু চির সুখের এই আবাসটি পেতে হলে দুনিয়ার জীবনে অবশ্যই বিশ্বাস ও কর্মপন্থা পুনর্গঠিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যদি দুনিয়াকে আহরণ করার জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করা হয় এবং নিজের বিশ্বাস ও কর্মপন্থাকে সেই ধাঁচে প্রস্তুত করা হয় তাহলে নিকৃষ্ট আবাসস্থল অপেক্ষা করছে। তখন আপনার সমস্ত সম্পদ উত্তম আবাসে যাওয়ার জন্য কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের রবের দাওয়াত গ্রহণ করেছে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে, আর যারা তা গ্রহণ করেনি তারা যদি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং এ পরিমাণ আরও সংগ্রহ করে নেয় তাহলেও তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য এ সমস্তকে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে দিতে তৈরি হয়ে যাবে। তাদের হিসাব নেওয়া হবে নিকৃষ্টভাবে এবং তাদের আবাস হবে জাহান্নাম, বড়ই নিকৃষ্ট আবাস।’ সুরা রাদ : ১৮
নিকৃষ্ট আবাসনের বাসিন্দা : কারা নিকৃষ্ট আবাসনের বাসিন্দা হবে, তাদের পরিচয় উল্লিখিত আয়াতে দেখেছেন। তাছাড়া এই সুরার ২৫ নম্বর আয়াতে আবার বলা হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর অঙ্গীকারে মজবুতভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভেঙে ফেলে, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক জোড়া দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন সেগুলো ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তারা লানতের অধিকারী এবং তাদের জন্য রয়েছে আখেরাতে বড়ই খারাপ আবাস।’ সুরা রাদ : ২৫
এখানে অঙ্গীকারের অর্থ হচ্ছে, সেই অনন্তকালীন অঙ্গীকার যা সৃষ্টির শুরুতে আল্লাহ সব মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তিনি অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, মানুষ একমাত্র তার বন্দেগি করবে এবং প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকেই এই অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আর (হে নবী!) লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেছিল, নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষী দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো একথা জানতাম না।’ সুরা আরাফ : ১৭২
এই ওয়াদা করার পর যারা দুনিয়ায় তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দুনিয়ার জীবনযাপন করে তাদের কাছ থেকে ‘কড়া হিসাব’ নেওয়া হবে। তাদের ভুল-ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা হবে না। এর বিপরীতে যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ত আচরণ করে এবং তার প্রতি অনুগত থেকে জীবনযাপন করে তাদের থেকে ‘সহজ হিসাব’ নেওয়া হবে। তাদের বিশ্বস্ততামূলক কার্যক্রমের মোকাবিলায় ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। তাদের কর্মনীতির সুকৃতিকে সামনে রেখে বহু ভুল-ভ্রান্তি উপেক্ষা করা হবে। হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে এ ধরনের বর্ণনা রয়েছে।
উত্তম আবাসনের অধিকারীরা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে তাকে যে ব্যক্তি সত্য মানে আর যে ব্যক্তি এ সত্যটির ব্যাপারে অন্ধ, তারা দুজন সমান হবে, এটা কেমন করে সম্ভব? উপদেশ তো শুধু বিবেকবান লোকেরাই গ্রহণ করে। আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন হয় যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না। তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষুণœ রাখার হুকুম দিয়েছেন। সেগুলো তারা অক্ষুণœ রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসাব না নেওয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, আমার দেওয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের ঘর হচ্ছে তাদের জন্যই অর্থাৎ এমনসব বাগান যা হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস। তারা নিজেরা তার মধ্যে প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদারা ও স্ত্রী-সন্তানদের মধ্যে থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে তারাও তাদের সঙ্গে সেখানে যাবে। ফেরেশতারা সবদিক থেকে তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আসবে এবং তাদের বলবে, তোমাদের প্রতি শান্তি। তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে আজ তোমরা এর অধিকারী হয়েছো। কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের ঘর।’ সুরা রাদ : ২০-২৪
উল্লিখিত আয়াতে উত্তম আবাসনের মালিকদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আয়াতে বন্ধন ও সম্পর্ক বলতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে বুঝানো হয়েছে। যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের সামগ্রিক জীবনের কল্যাণ ও সাফল্য নিশ্চিত হয়। আর যেগুলো ছিন্ন করলে ইসলামি জীবন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আর সবর করা মানে নিজেদের প্রবৃত্তি ও আকাক্সক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের আবেগ, অনুভূতি ও ঝোঁক প্রবণতাকে নিয়ম ও সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখে, আল্লাহর নাফরমানিতে বিভিন্ন স্বার্থলাভ ও ভোগ-লালসার চরিতার্থ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দু’পায়ে তা দূরে ঠেলে দেয় এবং আল্লাহর হুকুম মেনে চলার পথে যেসব ক্ষতি ও কষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয় সেসব সহ্য করে যেতে থাকে। এ দৃষ্টিতে মুমিন জীবন পুরোটাই সবরের ওপর নির্ভরশীল। কারণ সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এবং আখেরাতের স্থায়ী পরিণামের কথা চিন্তা করে দুনিয়ায় আত্মসংযম করে এবং সবরের সঙ্গে মনের প্রতিটি পাপ প্রবণতার মোকাবিলা করে।
ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। তারা অন্যায়ের মোকাবিলা অন্যায়কে সাহায্য না করে ন্যায়কে সাহায্য করে। কেউ তাদের প্রতি যতই জুলুম করুক না কেন তার জবাবে তারা পাল্টা জুলুম করে না বরং ইনসাফ করে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে যতই মিথ্যাচার করুক না কেন জবাবে তারা সত্যই বলে। কেউ তাদের সঙ্গে যতই বিশ্বাস ভঙ্গ করুক না কেন জবাবে তারা বিশ্বস্ত আচরণই করে।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসখানা এ অর্থই ব্যক্ত করে। যেখানে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের কর্মধারাকে অন্যের কর্মধারার অনুসারী করো না। এ কথা বলা ঠিক নয় যে, লোকেরা ভালো করলে আমরা ভালো করবো এবং লোকেরা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করবো। তোমরা নিজেদের একটি নিয়মের অধীন করো। যদি লোকেরা সদাচরণ করে তাহলে তোমরাও সদাচরণ করো। আর যদি লোকেরা তোমাদের সঙ্গে অসৎ আচরণ করে তাহলে তোমরা জুলুম করো না।’
এ প্রসেঙ্গে আরেক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ আমাকে নয়টি বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন। এরমধ্যে তিনি এ চারটি কথা বলেছেন, এক. কারও প্রতি সন্তুষ্ট-অসন্তুষ্ট যাই থাকি না কেন সর্বাবস্থায় আমি যেন ইনসাফের কথা বলি। দুই. যে আমার অধিকার হরণ করে আমি যেন তার অধিকার আদায় করি। তিন. যে আমাকে বঞ্চিত করবে আমি যেন তাকে দান করি। চার. আর যে আমার প্রতি জুলুম করবে আমি যেন তাকে মাফ করে দেই।
Leave a Reply