টেক ডেস্কঃ বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ‘কনটেন্ট’ (যেমন- বক্তব্য, ছবি, ভিডিও) চট করে সরানো সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রযুক্তি বিশ্বের কোথাও নেই। শুধু ওই সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের নিজস্ব ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ বা ব্যবহার নীতিমালা অনুযায়ী রিপোর্ট বা অনুরোধ পাঠালে তারা নির্দিষ্ট কোনো ‘কনটেন্ট’ সরিয়ে নিতে পারে। এ ছাড়া যে ব্যবহারকারী ওই কনটেন্ট আপলোড করেছেন, তিনি নিজে চাইলে সরিয়ে নিতে পারেন। এর বাইরে কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তায় হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, টেলিগ্রাম, ইমো, সিগন্যালের মতো প্ল্যাটফর্মের কল বা মেসেজ পড়া গেলেও আপলোড করা কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তা কার্যকর নয়।
সঙ্গে আলাপকালে এ মত দিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির। তবে অন্য একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ফেসবুক বিভিন্ন দেশের স্থানীয় ভাষা পড়ার ক্ষমতা উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্ষতিকর, মানহানিকর, উত্তেজনা কিংবা ঘৃণা ছড়ানোর মতো ‘কনটেন্ট’ দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলায় শব্দভান্ডারের অনেক কিছুই ইউনিকোড ফরম্যাটে না থাকায় প্রযুক্তিটি তেমন কার্যকর করা যাচ্ছে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে পরিচালিত হয় :ফেসবুক, ইউটিউব এবং এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজস্ব সার্ভার, নিজস্ব ক্লাউডিং ব্যবস্থা, নিজস্ব সাবমেরিন কেবল নেটওয়ার্ক এবং নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ব্যবহারকারীকে একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। সেই অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী নিজ দায়িত্বে পরিচালনা করেন এবং তার খুশিমতো কনটেন্ট আপলোড করার সুযোগ পান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যেমন- অ্যাকাউন্ট খোলার সময় গ্রাহকের জন্মতারিখ, মোবাইল ফোন নম্বর, ই-মেইল অ্যাকাউন্টের মতো ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হয়, সেগুলো এনক্রিপটেড থাকে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত যোগাযোগের ডাটা, যেমন- কেউ ফেসবুক মেসেঞ্জারে যে কথোপকথন বা চ্যাট করে, তা এনক্রিপটেড থাকে। কারণ, সব কর্তৃপক্ষই ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তা ভেঙে ফেলা খুব সহজ নয় বা এক অর্থে দুঃসাধ্য। বিশেষ করে কোনো ব্যবহারকারী যখন একটা কনটেন্ট আপলোড করে, তা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষ এবং যিনি ব্যবহারকারী, তিনিই কেবল সরিয়ে নিতে পারেন। দূর থেকে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের তা মোটেও সম্ভব নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অন্য কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের পক্ষেও সম্ভব নয়। অনেক থার্ড পার্টি কোম্পানি আছে, তারা তাদের প্রযুক্তিপণ্য বেচার জন্য অনেক ধরনের টোপ দেয়, এনক্রিপশন ভাঙার নানা কেরামতি দেখায়। কিন্তু বাস্তবে এগুলো খুব বেশি কাজ করে না। আবার বিশ্বজুড়ে আলোচিত পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে ডিভাইসের মাইক্রোফোন, স্পিকার হ্যাক করে কথোপকথন, চ্যাট হয়তো কেউ পড়তে পারে; কিন্তু তারও বড় বিপদ আছে। এটা এমন প্রযুক্তি, আপনি কাউকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছেন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে আপনি নিজেও ঘায়েল হয়ে বসে আছেন। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এ ধরনের প্রযুক্তি দিয়েও কিন্তু ফেসবুক বা ইউটিউবে ব্যবহারকারীর আপলোড করা কনটেন্ট সরানো সম্ভব নয়। অতএব, যদি আপলোড করা কনটেন্ট অপসারণের বিষয় আসে, সেটা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব।
তিনি বলেন, যেসব তথ্য দিলে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, তারা কিন্তু সেগুলো দেয় না। যেমন- ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ যেসব তথ্য চায়, সেগুলো ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার নীতির বিরুদ্ধে যায় না। কিন্তু মিয়ানমার সরকার যেসব তথ্য চায়, তা একবারেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। অতএব, এটা স্বাভাবিক যে ইউরোপের দেশগুলোর কর্তৃপক্ষের আবেদনে যেভাবে ফেসবুক সাড়া দেবে, নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারের সরকারের ক্ষেত্রে তা দেবে না।
কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বিতর্ক: ফেসবুক-গুগলের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে নীতিমালায় পরিচালিত হয়, তাকেই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বকে একটি কমিউনিটি ধরে সেখানে যে ধরনের শব্দ ঘৃণা প্রকাশ, সহিংসতার জন্য ব্যবহূত হয়, কোনো বিশেষ জাতি-গোষ্ঠীকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়, উস্কানি দেওয়ার জন্য ব্যবহূত হয়, সেগুলো নির্দিষ্ট করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেসব শব্দ ব্যবহূত হলে সেগুলো সরিয়ে নেয় ফেসবুক। এ জন্য ফেসবুকে বা ইউটিউবে ব্যবহারকারীদের জন্য রিপোর্ট অপশন আছে। আবার নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিপরীত কোনো তথ্য দিলে সেগুলোও সরিয়ে নেয় ফেসবুক। যেমন কভিড-১৯ মহামারি চলার সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা এর স্বীকৃত কোনো সংস্থার বাইরে কোনো তথ্য দেওয়া হলে তা ‘ফেক’ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরিয়ে নিয়েছে ফেসবুক।
তবে বিতর্ক হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক আচরণ, প্রকাশ ও গ্রহণ করার রীতি আলাদা। এ কারণে বিশ্ব কমিউনিটির জন্য তৈরি করা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। আবার ব্যবহারকারী নিজের ইচ্ছামতো যা কিছু আপলোড করার স্বাধীনতা ভোগ করার কারণে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে, স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে অনেক মানুষের সুনাম ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রিপোর্ট করার সময়ের মধ্যেই মিথ্যা, মানহানিকর, গুজবের মতো কনটেন্ট, পোস্ট কিংবা লাইভের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেসবুক ও ইউটিউব এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেনি।
বিটিআরসি যেভাবে কাজ করে: দেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) কীভাবে ফেসবুক, ইউটিউবের মতো মাধ্যমের কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে, তার একটা বর্ণনা গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার। তিনি বলেন, সাইবার মনিটরিংয়ের মূল কার্যক্রমটি করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি। তারা ক্ষতিকর কনটেন্ট চিহ্নিত করে বিটিআরসির কাছে পাঠায়। সে অনুযায়ী বিটিআরসি কনটেন্ট সরানোর জন্য ফেসবুক, ইউটিউব বা এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানায়। আবার অনেক মানুষ বিটিআরসির হটলাইন, অনলাইন এবং ই-মেইলে ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানোর জন্য অনুরোধ জানায়। এখানে একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কনটেন্ট সরানোর অনুরোধের সঙ্গে ফেসবুক-ইউটিউব কর্তৃপক্ষ আদালতের রায়, নির্দেশনা কিংবা আদেশের কপি চায়। সরকারি সংস্থার তালিকার ক্ষেত্রে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ অনুসরণ করা হয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানোর যেসব অনুরোধ আসে, সেখানে আদালতের নির্দেশনা কিংবা আইনগত পদক্ষেপের বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। এ কারণে তখন কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ জানালেও ফেসবুক বা ইউটিউব সাড়া দেয় না। তার পরও বিটিআরসি বারবার অনুরোধ করে। যিনি অভিযোগ করেন, তাকে জিডি করার কিংবা এ ধরনের আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যখনই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষতিকর কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ ও সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি বিশেষ সেল গঠনের কথা জানিয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্য: ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিটিআরসি আইনগত ক্ষমতা অনুযায়ী মোবাইল অপারেটর, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসহ এ ধরনের সংস্থা থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অন্য অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যদি ফেসবুকের একটা কনটেন্ট বন্ধ করতে হয়, তাহলে সে ব্যাপারে ফেসবুকের কাছে অনুরোধ জানাতে হয়। ফেসবুক তখন তার নিজস্ব কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বিবেচনা করে কোনো কনটেন্ট লিঙ্ক সরিয়ে নেয়, কোনোটা সরায় না। এ ক্ষেত্রে আর কিছুই করার থাকে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়াজুড়েই ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর এটাই ব্যবস্থা। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাছে এক রকমের অসহায়ত্ব বোধ করতে হয়। তারা তাদের মতো করে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বানায়, তাদের কৃপার ওপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না।
Leave a Reply