ইসলামিক নিউজ ডেস্কঃ দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন নয়, মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন। কারণ দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসা, আরাম-আয়েশ ও সাজ-সজ্জা মানুষকে নানাভাবে প্রতারিত করে, ধোঁকায় ফেলে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বররা আগমন করেনি? যারা তোমাদের আমার বিধানাবলি (ধর্মের কথা) বর্ণনা করতেন এবং তোমাদের আজকের (কিয়ামতের) দিনের সাক্ষাতের ভীতি প্রদর্শন করতেন? তারা বলবে (স্বীকারোক্তি দেবে), আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম। (এরপর মানুষের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলছেন) পার্থিব জীবন তাদের প্রতারিত করেছে। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।’ সুরা আনআম : ১৩০বর্ণিত কোরআনের আয়াতে একটি প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নটি হাশরের ময়দানে জিন ও মানব সম্প্রদায়কে করা হবে। তা হলো তোমরা কী কারণে কুফর ও আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হলে? তোমাদের কাছে কি আমার নবী পৌঁছাননি? তিনি তো তোমাদের মধ্যেই ছিলেন এবং আমার আয়াতগুলো তোমাদের পাঠ করে শোনাতেন, আজকের দিনের উপস্থিতি এবং হিসাব-কিতাবের ভয় প্রদর্শন করতেন। এর উত্তরে তাদের সবার পক্ষ থেকে নবীদের আগমন, আল্লাহর বাণী পৌঁছানো এবং এতদসত্ত্বেও কুফরে লিপ্ত হওয়ার স্বীকারোক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাফসিরে কুরতুবি
তাফসিরে আরও বলা হয়েছে, তাদের পার্থিব জীবন ও ভোগ-বিলাস ধোঁকায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে তারা একেই মুখ্য মনে করেছে, অথচ এটা প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়। এভাবে তারা দুনিয়ার জীবনে রাসুলদের ওপর মিথ্যারোপ (তাদের মানেনি) করেছিল, তাদের আনীত সত্য (দ্বীন) ইমান আনতে অস্বীকার করেছিল। ইবনে কাসির
নয়নাভিরাম পৃথিবী, বিপুলা সৌন্দর্যের আঁধার। অথচ মানুষ ভেবে দেখে না, এই পৃথিবী থাকার স্থান নয়; এখানে চিরকাল থাকা যায় না। কেউ থাকেনি, থাকতে পারেনি। থাকতে পারবে না, থাকা সম্ভবও না। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে, আসল ঠিকানা ভুলে থাকে। মানুষ হিসেবে আমাদের কোন জীবন বেছে নেওয়ার কথা ছিল, আর কোনটি নিচ্ছে মানুষ। এটা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। পরকালের অন্তহীন জীবনে সুখ-শান্তি আর সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, তা কি মানুষ করতে পেরেছে? মানুষ তো ভুলেই গেছে পৃথিবী তার আসল ঠিকানা নয়! এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো। অথচ পরকালের জীবনই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ সুরা আলাক : ১৬-১৭
পৃথিবী এবং তার সমস্ত বস্তু ধ্বংসশীল। পক্ষান্তরে পরকালের জীবন হলো চিরস্থায়ী। আর কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি, কখনো চিরস্থায়ী বস্তুর ওপর ধ্বংসশীল ক্ষণস্থায়ী বস্তুকে অগ্রাধিকার দেয় না। সে হিসেবে বলা যায়, আখেরাত দুই দিক দিয়ে দুনিয়ার মোকাবিলায় অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। প্রথমত তার সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ দুনিয়ার সব নেয়ামতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ও অনেক উচ্চপর্যায়ের। দ্বিতীয়ত দুনিয়া ধ্বংসশীল এবং আখেরাত চিরস্থায়ী। ইবনে কাসির
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া তো শুধু এমন যেন তোমাদের কেউ সমুদ্রে তার আঙুল ডুবিয়েছে। তারপর সে যেন দেখে নেয় সে আঙুল কী নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে?’সহিহ্ মুসলিম : ২৮৫৮
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমাদের সামনে দুনিয়াকে আগে পেশ করা হয়েছে। আর আখেরাতকে দুনিয়ার পেছনে রেখে আখেরাতের বৃত্তান্ত আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা দুনিয়াকে আঁকড়ে ধরেছি। আর আখেরাতকে পরিত্যাগ করেছি।’ দুনিয়া হলো দ্রুত প্রস্থানকারী তুচ্ছ বিষয়, যা মরীচিকার মতো চমকায় এবং মেঘমালার মতো চলমান। এর মধ্যে যা কিছু আছে তার সবই ধ্বংস হবে।
মৃত্যু হলো প্রবলভাবে গ্রাসকারী এমন এক বস্তু যা অভীষ্ট লক্ষ্যকে বিদ্ধ করবেই। সুতরাং ওই ব্যক্তিই বিচক্ষণ, যে জীবন শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়। হঠাৎ মৃত্যু আসার আগেই আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করে এবং সবকিছু নিঃশেষ হওয়ার আগে উদ্যোগ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে তারা মূর্খ ও প্রতারিত, যারা মৃত্যু ও নিয়তিকে ভুলে থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট করে। শেষ পরিণাম না ভেবে গাফেল থাকে। প্রাচুর্য ও গৌরব অর্জনের প্রতিযোগিতায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তারা জানে না আগামী দিনে তাদের সামনে রয়েছে কঠিন বিপদ। হতে পারে উপদেশ গ্রহণ করার পূর্বেই উদাসীন ব্যক্তির মৃত্যু এসে যাবে। এতে সে দুনিয়া থেকে প্রস্থান করবে। তার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হবে। অথচ সে সামান্য বস্তুও দান-খয়রাত করে যায়নি। মৃত্যু তাকে পাকড়াও করবে। অথচ সে কোনো হক আদায় করেনি। জ্ঞান চর্চামূলক কোনো কাজ করেনি। মানুষ ও জীবজন্তুর পানি পানের কোনো ব্যবস্থা করেনি, বৃক্ষরোপণ করেনি। মসজিদ তৈরির কাজে অংশগ্রহণ করেনি, সন্তান-সন্তুতিদের কোরআন শিক্ষা দেয়নি; কোনো কিছু ওয়াকফ করেনি। সে ছিল বিভ্রান্ত ও বিবেকহীন। আফসোস তার জন্য, সে কৃপণতা করেছে এবং পরকালের জন্য কোনো পাথেয় সংগ্রহ করেনি। সে সম্পদ সঞ্চয় করেছিল। এখন তা ভোগ করবে অন্যরা। আপনারা নিজ কৃতকর্ম ও জীবনকাল শেষ হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করুন। আখেরাতের কল্যাণ লাভের জন্য নিজেদের সম্পদ থেকে খরচ করুন। এক হাদিসে আছে, ‘একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরা তাকাসুর তেলাওয়াত করে বলছিলেন, মানুষ বলে আমার সম্পদ, আমার সম্পদ। অথচ তোমার অংশ তো ততটুকু যতটুকু তুমি খেয়ে ফেলো। অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও। অথবা সদকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এ ছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে। তুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে।’ তিরমিজি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কি নিজের সম্পদ থেকে তার উত্তরাধিকারীর সম্পদকে অধিক প্রিয় মনে করে? উত্তরে উপস্থিত সবাই বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তার নিজের সম্পদকে অধিক প্রিয় মনে করে না। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় মানুষের নিজের সম্পদ তাই যা সে সৎ কাজে ব্যয়ের মাধ্যমে আগে পাঠিয়েছে। আর যা সে পেছনে রেখে যাবে তা তার ওয়ারিশদের সম্পদ।’ সহিহ্ বোখারি
সুতরাং দুনিয়ার জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন, চিরবিদায়ের দিনকে স্মরণ করুন, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কথা মনে করুন, মৃত্যু আসার আগেই সৎ কাজের বীজ বপন করুন।
২৭ আগস্ট শুক্রবার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
Leave a Reply