নিউজ ডেস্কঃ অতিমারি করোনাভাইরাসে ‘দু:সহ’ সময় অতিবাহিত করছেন সিলেটের মানুষ। বিশেষ করে গেল জুলাই ছিল এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ‘ভয়ংকর’ এক মাস। এ মাসে এ বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ২২০ জনের। আর পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার।
গত দুই বছরের পরিসংখ্যানে সিলেটকে এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়নি। জুনের শেষ দিকে এসে সিলেটে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। সিলেটকে যখন করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট গ্রাস করছিলো তখনই শুরু হয় লকডাউন। ফলে ১ জুলাই থেকে লকডাউনকে সিলেটের জন্য ‘আশীর্বাদ’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। আশা করেছিলেন, লকডাউনের কারণে সিলেটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু ঘটলো ঠিক তার উল্টো। বরং জুলাই মাসজুড়ে সিলেটে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। অবস্থা এমন যে, এখন এ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড তো মিলছেই না, পাওয়া যাচ্ছে না সাধারণ বেড। এ অবস্থায় লোকজন রাস্তায়-অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাচ্ছেন।
করোনার কারণে এখন বিপর্যস্ত সিলেট। জুলাইয়ে প্রথম তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন কার্যকরে সিলেটে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছিলো সিলেটের প্রশাসনকে। কিন্তু ঈদের পর শুরু হওয়া লকডাউনে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বরং করোনার কঠিন পরিস্থিতির কারণেই সিলেটের মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে লকডাউন পালন করেন। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এখন সচেতন মানুষ অনেকেই বের হচ্ছেন না। সিলেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই বিষয়টি ইতোমধ্যে আমলে নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিত্যপণ্যের বাজার কর্তৃপক্ষকে বেলা ৩টার মধ্যে বন্ধ করে দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে- গণপরিবহন চলার খবরে সিলেটে পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে লকডাউন। মানুষের যাতায়াত ছিল বেশি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১ জুলাই পর্যন্ত সিলেটে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৭৮ জন। ওই সময় সিলেট জেলার ৩৯১ জন, সুনামগঞ্জের ৩৩ জন, হবিগঞ্জের ১৯ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ৩৫ জন মারা গিয়েছিলেন। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৯৮১ জন। সিলেটে ১৭ হাজার ১৯৪ জন, সুনামগঞ্জে ৩ হাজার ৬ জন, হবিগঞ্জে ২ হাজার ৭৫৬ জন ও মৌলভীবাজারে ৩ হাজার ২৫ জন শনাক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর পরই সিলেটে বদলে যায় পরিস্থিতি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে করোনার শনাক্তের হার। সেই সঙ্গে চলে মৃত্যুর মিছিলও। ৩১ জুলাই মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯৩ জনে। এরমধ্যে সিলেট জেলায় মারা গেছেন ৫৫৪ জন ও সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ১৪ জন। বাকিদের মধ্যে সুনামগঞ্জের ৪৯ জন, হবিগঞ্জের ৩০ জন ও মৌলভীবাজারের ৬০ জন রয়েছেন। এক মাসে সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে সিলেট জেলায়। এখানে মারা গেছেন ১৬৩ জন। মৌলভীবাজারে ২৫ জন, সুনামগঞ্জে ১৫ জন ও হবিগঞ্জে ১১ জন মারা গেছেন। এক মাসে সিলেট জেলাতেই সংক্রমিত হয়েছেন ৭ হাজার ৭৪৩ জন। এছাড়া, মৌলভীবাজারে ২ হাজার ৩৯৪ জন, হবিগঞ্জে ১ হাজার ৭৯৩ জন ও সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৫৯৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন। জুলাই মাসের শুরুতে সিলেটে হাসপাতালে রোগী ভর্তির জায়গা ছিল। কিন্তু ১০ জুলাইয়ের পর থেকে সিলেটে আইসিইউ সংকট দেখা দেয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইসিইউ বাড়িয়ে প্রায় ১৩০টি করা হলেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। আইসিইউর জন্য প্রায় তিনগুণ রোগী অপেক্ষায় থাকছেন। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এখন সাধারণ আইসোলেশন ওয়ার্ডেও বেড মিলছে না।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. ময়নুল হক জানান, সিলেট বিভাগের রোগী বাড়ায় ইতোমধ্যে ওসমানী হাসপাতালের গাইনী বিভাগ থেকে ১টি ও সার্জারী বিভাগ থেকে ১টি নিয়ে মোট ৪টি ওয়ার্ড করা হয়েছে। এ ৪ টি ওয়ার্ডে প্রায় সাড়ে ৩’শ রোগীকে সেবা দেয়া যাবে।
তিনি আরো জানান, এখন ওসমানী হাসপাতালে ৬ শিফটে করোনা স্যাম্পল পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ৬ শিফটে প্রতিদিন প্রায় পৌণে ৬’শ করোনার স্যাম্পল পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ওসমানী হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা: আবুল কালাম আজাদ জানান, সোমবার সকাল পর্যন্ত সিলেটে ওসমানী হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে ৩২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে বলে জানান তিনি।
সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, ইতোমধ্যে রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় ওসমানী হাসপাতালে নতুন ১০টি আইসিইউ বেড এবং ৭০ টি সাধারণ বেড বাড়ানো হয়েছে। ওসমানী হাসপাতালের নতুন ভবনে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪’শ বেড বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, করোনা নিয়ন্ত্রণে সিলেটের মানুষের জন্য গণটিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টিকা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে তবেই এ বিপর্যয় থেকে মুক্তি মিলবে।
২৪ ঘন্টায় ১৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৫৩ ॥ সিলেটে একদিনে গত রোববার আক্রান্ত হয়েছেন ৯৯৬ জন। এটাই হচ্ছে সিলেটে সর্বোচ্চ রেকর্ড। আর গতকাল সোমবার আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৩ জন। নতুন শনাক্তদের মধ্যে সিলেট জেলাতেই রয়েছেন ৩৬০ জন, সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ১১৯ জন, সুনামগঞ্জে ১০৭ জন, হবিগঞ্জে ৭৭ জন ও মৌলভীবাজারে ১৯০ জন শনাক্ত হয়েছেন। সিলেটে মৃতের সংখ্যা এখন ৭১৬ জন। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ৫৫০ জন, সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ২১ জন, সুনামগঞ্জে ৫২ জন, হবিগঞ্জে ৩২ জন ও মৌলভীবাজারে ৬১ জন মারা গেছেন।
এদিকে, গত ২৪ ঘন্টায় (রোববার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ১৪ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮৫৩ জনের। এ সময় ১৯৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় উল্লেখিতদের রোগী শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪৩.৬৫ ভাগ।
এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৫ জন। আর করোনা থেকে মুক্ত হয়েছেন ৪৬৮ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন শনাক্ত ৮৫৩ জনের মধ্যে সিলেট জেলার ৩৬০ জন, সিলেট ওসমানী হাসপাতালের ১১৯ জন, সুনামগঞ্জ জেলার ১০৭ জন, হবিগঞ্জ জেলার ৭৭ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ১৯০ জন।
আর, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগে মারা যাওয়া ১৪ জনের মধ্যে সিলেট জেলার ৬ জন, সিলেট ওসমানী হাসপাতালের ৪ জন, সুনামগঞ্জের ১ জন, হবিগঞ্জের ২ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ১ জন। এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ৭১৬ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগের মধ্যে সিলেট জেলার ৪২ জন, ওসমানী হাসপাতালের ২৫ জন, সুনামগঞ্জ জেলায় ৫ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ১০ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ৩ জন করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চার জেলায় বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪২২ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ২৯৯ জন, সুনামগঞ্জ জেলায় ৬৪ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ৩৮ জন ও মৌলভীবাজার জেলায় ২১ জন।
গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনামুক্ত ৪৬৮ জনের মধ্যে সিলেট জেলার ২৩৬ জন, ওসমানী হাসপাতালের ৮ জন, সুনামগঞ্জ জেলার ৪৩ জন, হবিগঞ্জ জেলার ৪২ জন ও মৌলভীবাজার জেলায় ১৩৯ জন।
এই ২৪ ঘণ্টায় সিলেট জেলায় ১০৩২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৪৭৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। সুনামগঞ্জ জেলায় ২৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০৭ জন শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। হবিগঞ্জ জেলায় ১৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৭৭ জন শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৪৫৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৯০ জন শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হচ্ছে ৪১ হাজার ৩০৫ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলার ২২ হাজার ৪১৫ জন, ওসমানী হাসপাতালে ৩ হাজার ৪’শ জন, সুনামগঞ্জ জেলার ৪ হাজার ৮১৮ জন, হবিগঞ্জ জেলার ৪ হাজার ৯২৩ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ৫ হাজার ৭৪৯ জন।
অন্যদিকে, সিলেট বিভাগে করোনামুক্ত হয়েছেন ৩১ হাজার ৩১১ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলার ২১ হাজার ১৯১ জন, ওসমানী হাসপাতালে ২১৯ জন, সুনামগঞ্জ জেলার ৩ হাজার ৩৯৩ জন, হবিগঞ্জ জেলার ২ হাজার ৫৫৭ জন ও মৌলভীবাজার জেলার ৩ হাজার ৯৫১ জন।
Leave a Reply