স্পোর্টস ডেস্কঃ আর্জেন্টিনা আর মেসিকে কোপা আমেরিকায় জেতানোর নায়কদের একজন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।
আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপাখরা ঘুচেছে। লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারের একমাত্র আক্ষেপও। আকাশি-সাদা জার্সিটাতে মেসির প্রথম কোনো বড় শিরোপা নিয়ে কাব্য কম হয়নি, চারদিকে বন্দনা মেসির। হবে নাই–বা কেন! আর্জেন্টিনার এবারের কোপা আমেরিকা জয় যে পুরোই মেসিময়! সেমিফাইনাল-ফাইনালে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে খেলেছেন মেসি, তবু টুর্নামেন্ট শেষে তিনিই সেরা খেলোয়াড়, যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা, গোল করানোর তালিকায়ও সবার ওপরে মেসি।
তবে আর্জেন্টিনার এত দিনের অপেক্ষা ফুরোনোতে সব কৃতিত্ব শুধুই মেসির নয়। সেখানে রদ্রিগো দি পলের নাম আসবে, ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে গোলদাতা আনহেল দি মারিয়ার কথা আসবে, আসবে ইনজেকশন নিয়ে ফাইনালে ৭৮ মিনিট খেলা ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, মাঝমাঠে ভরসা জোগানো জিওভান্নি লো সেলসো, নেইমারকে আটকে রাখা রাইটব্যাক গঞ্জালো মন্তিয়েল, লিয়ান্দ্রো পারেদেস কিংবা টুর্নামেন্টের মাঝপথে এসে ছন্দ খুঁজে নিয়ে ৩ গোল করা স্ট্রাইকার লওতারো মার্তিনেজের কথা। একটা দল হয়েই খেলেছে আর্জেন্টিনা!
সে দলে বড় ভরসা হয়ে গোলপোস্টের নিচে ছিলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। গত জুনেই আর্জেন্টিনা জার্সিতে অভিষেক তাঁর, এক মাস পর কোপা আমেরিকা শেষে আর্জেন্টিনার নায়কদেরই একজন বনে গেলেন ২৬ বছর বয়সী গোলকিপার। সেমিফাইনালে যেভাবে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়েছেন, যে ঢঙে স্লেজিং করেছেন প্রতিপক্ষকে… আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে মার্তিনেজের জায়গা করে নিতে আর কী লাগে!
সেই মার্তিনেজেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিখ্যাত আর্জেন্টাইন ক্রীড়াদৈনিক ওলে। নিজের কথা, মেসিকে নিয়ে মুগ্ধতার কথা, আর্জেন্টিনার শিরোপার উচ্ছ্বাস…কত কিছু নিয়েই না কথা বলেছেন আর্জেন্টাইনদের প্রিয় ‘দিবু’। স্প্যানিশ ভাষার সেই সাক্ষাৎকার আবার প্রসঙ্গ ধরে ধরে দুই পর্বে ভাষান্তরিত করে ইংরেজিতে দিচ্ছে আর্জেন্টিনার ফুটবলবিষয়ক বিখ্যাত আরেক ওয়েবসাইট মুন্দো আলবিসেলেস্তে। সেটির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে গতকাল, বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো…
এমিলিয়ানো মার্তিনেজ: (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে) মিম দেখে এটা বুঝতে পেরেছি। আমি মাঠে কী বলেছিলাম (কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে টাইব্রেকারের সময়ে) এটা দেখে মানুষ খুব চমকে গেছে, কিন্তু আমার কাছে এটা স্বাভাবিকই। যারা আমাকে চেনে, তারা জানেন মানুষ হিসেবে আমি কেমন। কারও জন্যই আমি বদলাব না। যা করি, তা অনেক প্যাশন নিয়েই করি। সেটির জন্য লড়াইয়ে কোনো বাধা মানি না। মাঠে দর্শক না থাকায় সবাই সবকিছুই শুনতে পাচ্ছে।
আমি যা বলেছি, তার কিছুই একেবারে অভাবনীয় কিছু নয়। আমি শুধু পেনাল্টি কিক নিতে আসা খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আগে এটা সেভাবে দেখা যায়নি, কিন্তু আমি এটা সব সময়ই করি। প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার জন্য করি না, করি নিজেকে সাহস জোগাতে, নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে। জানি, আমি টাইব্রেকারে পাঁচটা শটের মধ্যে তিনটা ঠেকিয়েছি বলে—চিলির বিপক্ষে ম্যাচে পেনাল্টি হিসেবে নিলে ছয়টির মধ্যে চারটি—মানুষ আমার এসব কথাতে অনেক মজা পাচ্ছে।
কিন্তু জানি, তখন পর্যন্ত আমি আর্জেন্টিনা দলে ছয় কি সাতটা ম্যাচই খেলেছি। তখনো কিছু জিতিনি। ফাইনালে যাওয়ার পর যদি সেখানে কোনো উল্টোপাল্টা কিছু হতো, তখন এসবের দাম কি থাকত? কিছুই না! মানুষের এখন এসব ভালো লাগছে আমরা ফাইনাল জিতেছি বলে। সেমিফাইনালে আমি ভাগ্যবান ছিলাম বলে পাঁচটার মধ্যে তিনটা শট ঠেকাতে পেরেছি।
কিন্তু যদি ফাইনালে আমি বড় কোনো ভুল করতাম বা ভুল করেও ভাবতাম ‘ব্যাপার না, পুরো দুনিয়া তো এখন আমাকে চেনে’, সে ক্ষেত্রে ফাইনালে হেরে গেলে কোনো লাভই হতো না। ওই ম্যাচে ওই মুহূর্তে আমি অনেক রোমাঞ্চিত ছিলাম। সংবাদমাধ্যম, মানুষ, মিম…সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে শুধু তা-ই করেছি, যেটা আমি সব সময় করি। যেটা আমি আর্সেনাল, রেসিং বা অ্যাস্টন ভিলায় করি। সত্যিটা হচ্ছে, মানসিক ও শারীরিকভাবে আমি সে সময়ে অনেক বেড়ে উঠেছি। আজ এই মুহূর্তে নিজেকে নিয়ে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। এভাবে আরও উন্নতি করে যেতে হবে।
মার্তিনেজ: এটা স্বাভাবিক। মানুষ গ্রেট আর্জেন্টাইন গোলকিপারদের মনে রেখেছে এমন ব্যবধান গড়ে দেওয়া মুহূর্তগুলোতে তাঁদের অবদানের জন্যই। গোলকিপারদের জীবনটাই এমন। সবাই নাম্বার নাইন বা নাম্বার টেনকে মনে করে। গোলকিপাররা সব সময় আড়ালেই থেকে যায়। গোলকিপারের গোলকিপার হওয়াও তো কোনো একটা কারণেই, তাই না? কারণ, সে নাম্বার টেনের মতো বল পায়ে অত ভালো খেলতে পারবে না।
কিন্তু আজ মানুষ আমাকে আমার কোনো একটা কথা বা কোনো একটা শট ঠেকানোর জন্য মনে রাখছে। বলছে, দিবু (মার্তিনেজের ডাকনাম) একটা সেভ করেছে। এমন কিছু মানুষ পাতোকে (২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গোলকিপার রবার্তো আবোনদানজিয়েরির ডাকনাম) নিয়ে বলতে শুনতাম। কোনো গোলকিপার ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ কোনো সেভ করলে মানুষ বলত, এই ছেলেটা পাতো কিংবা গয়চোর (১৯৯০ বিশ্বকাপের গোলকিপার সের্হিও গয়কোচিয়া) মতো সেভ করেছে। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে দারুণ কিছু দেখানোর কারণে ওই গোলকিপারদের মানুষ মনে রেখেছে।
বা চিকিতোকে (২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গোলকিপার সের্হিও রোমেরো) হাভিয়ের মাচেরানো যে কথাটা বলেছিলেন, যে কথাটা তাঁকে পেনাল্টি (২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে) ঠেকাতে সাহস জুগিয়েছিল, ওই কথাগুলোই ভেবে দেখুন।
লিও (মেসি, কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোপার সেমিফাইনালে টাইব্রেকারের সময়ে) ও রকম করে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, দেখো, তুমি ঠিকই একটা শট ঠেকিয়ে দেবে! আপনার দলে যখন এমন অমিত প্রতিভাবান একজন খেলোয়াড় থাকে, যে কিনা প্রতি ম্যাচে আপনার দলকে উদ্ধার করে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের জন্য সবকিছু নিংড়ে দেয়, তাকে ফাইনালে তুলতে একেবারে কম হলেও তো এতটুকু করতেই হয়! এটাই করতে চেয়েছি আমি।
মার্তিনেজ: উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ওদের ক্রসগুলো সামলে নিয়ো, ওরা ক্রসে অনেক আগ্রাসী।’ অধিনায়ক হিসেবে অনেক নির্দেশনা দেন তিনি, আমাদের সবাইকে সাহায্য করেন।
(সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে) তিনি পেনাল্টিতে গোল করার পর চাইলেই আবার ফিরে সোজা মাঝবৃত্তের দিকে চলে আসতে পারতেন, কিন্তু সেটা না করে তিনি আমার দিকে গেলেন, বললেন, ‘দেখো, তুমি ঠিকই একটা শট ঠেকিয়ে দেবে!’ পরের শটটাই ঠেকিয়ে দিলাম আমি! তাঁর প্রভাব এমনই। এটাকে শব্দে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এতটুকু বলি, তিনি অসাধারণ একজন অধিনায়ক, দুনিয়ার সব দলই তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে পেতে চাইবে।
মার্তিনেজ: ওটা দেখে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এই শব্দগুলো, এই ছবিগুলো এমন যেগুলো আপনি সারা জীবন নিজের কাছে রাখতে চাইবেন। ওর সঙ্গে আমার আলিঙ্গনের ছবি, এমন ছবি সারা জীবন রেখে দেওয়ার মতো। শুধু ইনস্টাগ্রাম পোস্টই নয়, সেমিফাইনালেও তিনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। (সেমিফাইনালের পর) সংবাদমাধ্যমের সামনেও আমাকে নিয়ে বলেছিলেন, এরপর ইনস্টাগ্রামে ছবি। এসব কিছু ফাইনালে আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে, আরও ভালো করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমাকে শক্তি জুগিয়েছে।
মার্তিনেজ: তিনি যে একটা ছবি দিয়ে ক্যাপশনে লিখলেন, ‘ও একটা ফেনোমেনন’, এরপর ফাইনালে কীভাবে আমি ভালো না খেলি! তাঁর জন্য আমি জীবন দিতে পারি, মরতে পারি। চার-পাঁচ মাসে আগেও বলেছিলাম যে আমার আগে তিনিই কোপা আমেরিকা জিতলে আমি বেশি খুশি হব (তখনো আর্জেন্টিনা দলে ডাক পাননি মার্তিনেজ)। এটা মন থেকেই বলেছি, প্রত্যেক আর্জেন্টাইনই এটাই বলবে। আমার মনে হয়, ব্রাজিলিয়ানরাও আর্জেন্টিনাকে কোপা জিততে দেখতে চেয়েছিল শুধু মেসির কারণে। আর সেখানে একজন আর্জেন্টাইন চাইবে না মেসি এটা জিতুক? শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে। এখন আমার স্বপ্ন, আমরা তাঁকে যেন বিশ্বকাপটাও উপহার দিতে পারি।
মার্তিনেজ: (টুর্নামেন্টে টানা ৪৫ দিন জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকার সময়ে) আমরা ট্রুকো (কার্ডের খেলা) খেলতাম। মার্চেসিন, মুসো আর আমি এক দলে, অন্য দিকে মেসি, পারেদেস আর দি পল। ২০-৩০ রাতে আমরা ট্রুকো খেলেছি।
তিনি আর দশজন মানুষের মতোই! অসাধারণ একজন মানুষ, যিনি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিততে খুব করে চাইতেন, সম্ভবত জাতীয় দলে অন্য যে–কারও চেয়ে বেশি করে চেয়েছেন। তাঁর এই চাওয়াটাই আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের গ্রুপটাতে নতুন অনেক খেলোয়াড় এসেছে, সবার মধ্যে এই মানুষটার জেতার বাসনা ছড়িয়ে গেছে। এরপর আমরা কিছু জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে না পড়ি কীভাবে?
মার্তিনেজ: আপনারাই লিখেছেন, আমি এমন একজন আর্জেন্টাইন, যে কিনা তার স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছে। সেটার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই থামাইনি। আমি জানি না লিও আর কতগুলো কোপা আমেরিকা বা বিশ্বকাপ খেলতে পারবে, অন্তত একটা কোপা আমেরিকা তাঁর পাশে খেলতে পারা…কোপা আমেরিকায় যখন আমার অভিষেক হয়েছে, আমি তখনই বলেছিলাম, আমার স্বপ্ন ছোঁয়া হয়ে গেছে।
এরপর আমরা শিরোপাও জিতলাম, এটা আমি কল্পনাতেও ছিল না। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের সঙ্গে যেকেউই খেলতে চাইবে, আর একই দলে থেকে তাঁকে খেলতে দেখা (গোলপোস্টে) আমাকে আরও ভরসা দিয়েছে, খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে আরও ভালো বানিয়েছে।
আপনারাই লিখেছেন, তিনি অন্য খেলোয়াড়দের ভালো খেলতে সাহায্য করেন। সেটা সাধারণত মাঠের অন্য নয়জনকে নিয়ে বলা হয়, কিন্তু তিনি আমাকেও ভালো খেলতে সাহায্য করেছেন, অথচ আমি একজন গোলকিপার! আমার মনে হয়, যদি তাঁর সঙ্গে একই লিগে প্রতি ম্যাচ খেলতে পারতাম! গোলকিপার হিসেবে আরও ভালো হয়ে উঠতাম।
অ্যাস্টন ভিলায় দারুণ মৌসুম শেষে জাতীয় দলের সঙ্গে ৪৫ দিন ছিলাম। অ্যাস্টন ভিলায়ও আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছি আমি, কিন্তু জাতীয় দলে আরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উন্নতি করেছি। ছোটবেলায় আপনি ‘ড্রাগন বল জি’ (জাপানিজ অ্যানিমে টিভি সিরিজ) দেখেছেন? আমি সেখানকার ভেগেটা ছিলাম, মেসির সঙ্গে খেলার সময়ে আমি সেখান থেকে সুপার সাইয়ান হয়ে গেলাম!
মার্তিনেজ: ঠিক কোনো নির্দিষ্ট মুভ দিয়ে উত্তর দেওয়া যাবে না। ফ্রি-কিকের কথা ধরুন, মেসির ফ্রি-কিক নেওয়া মানেই গোল হওয়ার পথে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া। একটা ডেড বল এটা, এটাতে তিনি ক্রস ঠিকঠাক লাগাতে পারলেই গোল। তিনি যখন বল পায়ে পান, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে তিনি সহজে বল হারাবেন না।
ধরুন আমরা ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ১-০ গোলে এগিয়ে আছি, মেসি বলটা নিয়ে প্রতিপক্ষ কর্নারের দিকে চলে যাবেন। তখনো ম্যাচের পাঁচ মিনিট বাকি থাকলেও আপনি ধরে নিতে পারেন আমরা ম্যাচটা জিতে গেছি।
এই ব্যাপারগুলোই আপনাকে অনেক নির্ভরতা দেবে। অ্যাস্টন ভিলায় আমরা কিছু ম্যাচ হেরেছি ৯১-৯২তম মিনিটে গোল খেয়ে। কিন্তু এখানে প্যারাগুয়ে কিংবা উরুগুয়ের মতো দলের বিপক্ষে ৮৯তম মিনিটেও বলটাকে আমরা ওদের কর্নারের দিকে নিয়ে যাওয়া মানে ধরে নেওয়া যায় আমরা ১-০ গোলে জিতছি। এই ব্যাপারগুলো স্বস্তি দেয়। এই যে ছোট ছোট ব্যাপার, এগুলো আমাদের সবাইকে নির্ভার হয়ে আরও ভালো খেলতে সাহায্য করেছে।
Leave a Reply