নিউজ ডেস্কঃ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যখন করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে শুরু করেছে, তখন আবারও নতুন চিন্তা দেখা দিয়েছে। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করছে। ফলে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষসহ সবার কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। গত বছরের এপ্রিল-মে-জুন সময়ের কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতার কারণে তাঁদের এই অবস্থা। করোনায় সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে ভয় পাওয়া দলের লোক।
বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা ইতিমধ্যে আভাস দিয়েছে, নতুন এই ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। গত জুন মাসের পর অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তা টেকসই নয়। গত বুধবার দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কাঠফাটা রোদে বিমানবন্দর সড়কের কাওলা বাসস্ট্যান্ডে উবারের মোটরসাইকেলচালক সুমন মাহমুদের সঙ্গে কথা হলো। সুমন মাহমুদ গুলশান আগোরায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। গত আগস্ট মাসে তাঁর চাকরি চলে যায়। সংসার চালাতে জমানো টাকায় একটি পুরোনো মোটরসাইকেল কিনে নেমে পড়েন রাইড শেয়ারিংয়ে। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয়ে সংসার মোটামুটি চলছে।
কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দুই সপ্তাহের জন্য উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং বন্ধ করেছে সরকার। বিপাকে পড়েছেন সুমন মাহমুদ। পেটের দায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘উপায় নেই। অ্যাপস বাদ দিয়ে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় যাচ্ছি। এমন রাইডারদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পথে আটকে দেয়, মামলা দেয়। তবু ঝুঁকি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি।’
এভাবে করোনার ঝুঁকি নিয়ে বহু উবার-পাঠাও চালক আয়ের সংস্থানে নেমেছেন। শুধু সুমন মাহমুদের মতো উবারচালক নন, দিনমজুর, সেলুনকর্মী, রেস্তোরাঁকর্মীসহ সবার মনে আবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ শ্রেণির মানুষজনই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন।
সার্বিকভাবে করোনার নতুন ঢেউ অর্থনীতিতে শঙ্কার পদধ্বনি জানান দিচ্ছে। এবার দেখা যাক, কী হতে পারে। বিধিনিষেধ কড়াকড়ি করা হলে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই প্রভাব পড়তে পারে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আবার লকডাউনে গেছে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদাও কমেছে। রপ্তানিও আগের মতো হচ্ছে না। প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা আসতে পারে। কারণ, করোনার কারণে এক বছর ধরে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া অনেক কমেছে, বরং অনেকে দেশে ফিরে আবার যেতে পারছেন না। দেশের ছোট ব্যবসায়ীরা আবারও বিপদে পড়তে পারেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। করোনার নতুন ঢেউয়ের কারণে এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত।’ তিনি আরও বলেন, কাঙ্ক্ষিত সরকারি সহায়তা না পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এই ধাক্কা তাঁদের পথে বসিয়ে দিতে পারে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাস রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউন থাকায় তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের সার্বিক রপ্তানিও কমেছে। ওই তিন মাসে (ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) একদিকে রপ্তানির লক্ষ্য যেমন অর্জিত হয়নি, তেমনি একই সময়ের তুলনায় আগের বছরের চেয়ে রপ্তানির পরিমাণও কমেছে। কিন্তু গত জুন মাসে কলকারখানা পুরোদমে খুলতে শুরু করলে রপ্তানিও বাড়তে থাকে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস রপ্তানির লক্ষ্য যেমন অর্জিত হয়েছিল, তেমনি আগের বছরের চেয়েও বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
পোশাক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘আগেরবারের মতো আবারও সবকিছু বন্ধ করে দিলে রপ্তানিতে ধস নামতে পারে। কারণ, আগেরবারে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সবকিছু বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন ভিয়েতনামসহ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো কলকারখানা খোলা রেখেছে।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি প্রবাসী আয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় প্রবাসী আয় না কমলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক যাওয়া ব্যাপক কমেছে। ফলে মাসওয়ারি ভিত্তিতে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় প্রবাসে শ্রমিক যাওয়া কমেছে ৭১ শতাংশ। এর প্রভাবও পড়েছে প্রবাসী আয়ে। গত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের মাসের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে। তবে করোনার আগের তুলনায় আয় বেড়েছে। মূলত ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ফলে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো বেড়েছে।
রামরুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের দামের পতন, পর্যটন ও সেবা খাতের ব্যবসায় ধসের কারণে শ্রমিকদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১ লাখ শ্রমিক আবার ফিরে যেতে পারেননি। গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রবাসে শ্রমিক পাঠানো এমনিতেই বন্ধ ছিল।
এ অবস্থায় করোনার আরেকটি ধাক্কা এলে প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোসহ প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার ব্যাপক শঙ্কা আছে। কারণ, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন না ওই সব দেশের দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। ফলে বিদেশি শ্রমিকের চাহিদাও কমে যেতে পারে।
করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, সারা দেশে এখন প্রায় ৪২ হাজার এমন কলকারখানা আছে। এসব খাতেই দেশের ৩৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা এই খাতে। প্রথম ধাক্কায় অনেকেই লোকসানে পড়েছেন। এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
করোনা মোকাবিলায় সার্বিকভাবে কী পরিকল্পনা থাকা উচিত—এমন প্রশ্নের জবাবে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, করোনা মোকাবিলায় তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দেওয়ার জন্য কিছু প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগসহ সার্বিক স্পষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। এমনকি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও অন্তর্বর্তীকালীন বিশেষ কোনো পরিকল্পনা রাখেননি নীতিনির্ধারকেরা। এ ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বিক কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার।
Leave a Reply