সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীতে বন্ধ হচ্ছে না বালু উত্তোলন। প্রায় প্রতিদিন অবৈধভাবে খননযন্ত্রের মাধ্যমে যাদুকাটার তীর কেটে লাখ লাখ টাকার বালু ও পাথর উত্তোলন করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এর প্রভাবে নদী সংলগ্ন প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অবৈধভাবে যাদুকাটা নদীর দুই তীর কেটে বালু ও পাথর উত্তোলনের প্রভাবে ইতিমধ্যে তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। কয়েক হাজার একর ফসলি জমি, সহশ্রাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনের আতঙ্কে এখন দিন কাটাচ্ছেন দুই উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। কিন্তু এসব দেখার যেনো কেউ নেই। যাদের দেখার কথা সেই প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও নেপথ্যের প্রভাবশালীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যাদের আটক করা হয় তারা সকলেই চুনোপুঁটি। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নদীর তীর কাটার প্রতিযোগীতা বেড়েই চলেছে।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের মানিগাঁও, বাদাঘাট ইউনিয়ন ঘাগড়া, সোহালা, ভোলাখালি, মাহাতাবপুর, কুনাটছড়া, শাহিদাবাদ, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সত্রিশ, মিয়ারছড়, লামাশ্রম গ্রামের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি শ্রমিক সর্দারদের সাথে নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করছেন। তারা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে নদীর তীর কেটে বালু ও পাথর বিক্রি করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত শ্রমিক ও নদীরপাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার ফুট ওজনের ৩০ থেকে ৪০টি স্ট্রিলবডি ইঞ্জিনের নৌকায় করে প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ ফুট বালু বিক্রি করা হচ্ছে পাড় কেটে। নদীর অবৈধ কোয়ারি ও পাড়কেটে বালু নেওয়ার জন্য নদীপাড় মালিক দাবিদারদেরকে প্রতিফুট বালুর জন্য ২টাকা, বারকি শ্রমিকদের সাড়ে ৪টাকা, ৫ থেকে ৭ হাজার ফুট বলগেইট স্ট্রিলবডি ইঞ্জিনের নৌকার জন্য ৩ হাজার টাকা করে দিতে হয় বাদাঘাট পুলিশ ফাঁড়ি ক্যাম্পের সোর্সদের। ক্যাম্পের সোর্স পরিচয় দিয়ে গাগটিয়া গ্রামের জনৈক আলীম উদ্দিন, কামড়াবন্দ গ্রামের ইব্রাহিম মিয়া, মানিগাঁও গ্রামের জালাল মিয়া এ টাকা আদায় করেন। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের নাম ভাঙিয়ে প্রতিফুট বালি থেকে ২টাকা করে চাঁদা নেন স্থানীয় এক সংবাদকর্মী। তার বিরুদ্ধে মাদক ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলাও রয়েছে। ওই ব্যক্তি প্রশাসনের অভিযানের খবর আগেই মুঠোফোনে জানিয়ে দেয় বালু ব্যবসায়ীদের। যার কারণে অনেককে আটক করা যায় না। নদী থেকে চাঁদা আদায়কারী কয়েজনের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যাদুকাটা নদীর তীর কেটে বালু ও পাথর উত্তোলন করে অবাধে বিক্রি করছে প্রভাবশালীরা। ফলে যাদুকাটা নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড়, ছড়ারপাড়, ঢালারপাড়, গাঘটিয়া, বড়টেক, বিন্নাকুলি, কাইলকাপুর, মোদেরগাঁও, গড়কাটি, গাঘড়া, পাঠানপাড়া, কুনাটছড়া, সোহালা গ্রামসহ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ারছড়, সত্যিস, আমড়িয়া, সিরাজপুর, বাগগাঁও, মনবেঘসহ প্রায় অর্ধশত গ্রাম। ঘাগটিয়া গ্রামের সামনে বিশাল বালুর চড় ছিল। বালুর চরের জন্য স্থানীয়রা একে বড়টেক বলে ডাকতেন। কিন্তু বালু উত্তোলনের কারণে গত কয়েক বছরে বড়টেক আজ বিলীন। তীর কেটে বালু বিক্রির কারণে এ গ্রামের ১০-১৫টি ঘর, ১টি স্কুল ও ১টি মসজিদ নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে।
সচেতন মহল জানান, উপজেলা প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে অবৈধ বালি বোঝাই নৌকা আটক করলে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রিত দালালরা এগুলো ছাড়িয়ে নিতে তৎপরতা চালায়। কিন্তু এলাকার চিহ্নিত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কখনো আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। যার কারণে বালি-পাথর উত্তোলন ও বিক্রি আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি।
চাঁদা আদায়কারী সোর্সদের ব্যাপারে তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ তরফদার বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু-পাথর বিক্রি কিংবা চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমার ক্যাম্পের কোনো সোর্স নাই। এব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখব। অন্যায়কারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
আলাপকালে তাহিরপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যারা অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে সবাইকে সর্তক করতে মাইকিং করা হয়েছে। কোনো অন্যায় ছাড় দেওয়া হবে না।’
Leave a Reply