কোভিড-১৯ করোনা মহামারিতে ব্যবসা-বাণিজ্য যেখানে স্থবির সেখানে বেচাকেনা বেড়েছে ডিজিটাল এবং অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য সেবা। গত রোজার ঈদে অন্যান্যবারের তুলনায় অন্তত চারগুণ বেশি অর্ডার পেয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ডিজিটাল মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের প্রবণতাও বেড়েছে গ্রাহকদের মাঝে।
গেল মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশে করোনা হানা দেওয়ার সময় থেকে প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিল দেশের বিপণিবিতান। ঈদের মৌসুমেও খুলেনি বড় বড় শপিং সেন্টার। আর পুরো করোনাকালই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য অফলাইনে ভরসা ছিল পাড়া মহল্লার মুদি দোকান এবং সুপার শপে। তবে ঘর থেকে বের হয়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করতে হয় বলে ছিল স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনই প্রেক্ষাপটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যোগানের হাল ধরাই নয় বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ঈদুল ফিতরের সময়েও সচেতন মানুষদের কেনাকাটার অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে ই-কমার্স। ফলে আগে থেকেই ই-কমার্স সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত থাকা গ্রাহকদের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে নতুন গ্রাহক। ই-কমার্সখাতের বেড়েছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।
সারা বাংলাদেশের মত মৌলভীবাজার জেলাতে এই খাতে যুক্ত হয়েছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। মৌলভীবাজার সাইক্লিং কমিউনিটির পরিচিত মুখ ইমন আহমেদ। করোনাকালে “চায়ের স্বর্গ ই-শপ” নামে ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে শুরু করেছে অনলাইন ব্যবসা। তিনি জানালেন, করোনাকালে কিছু একটা করার ইচ্ছে থেকেই যুক্ত হয়েছি। তবে ব্যবসায়িক চিন্তার পাশাপাশি, চায়ের দেশ খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার আসল চা পাতা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার মনোভাব নিয়ে আমি কাজ করছি।
পলি দত্ত পুরকায়স্থ কাজ করছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মনিপুরী শাড়িও নকশীকাথা নিয়ে। তার পেইজের নাম সৌহার্দ্য। তিনিও জানালেন, করোনার অবসর সময়ে নতুন কিছু করার চিন্তা থেকেই এই অনলাইন ব্যবসায় আসা।
শ্রীমঙ্গলের মিথিলা পাল মুন জানান, আমি মনিপুরী শাড়ি, বেডসিট, থ্রি-পিস, এপ্লিকের শাড়ি, বেডসিট, জামদানী থ্রি-পিস নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি করোনার এই সময়ে । ভালো সাড়া পেলে ইচ্ছে আছে শো-রুম খোলার।
মধুমিতা দেব কাজ করছেন বিভিন্ন ধরনের অলংকার নিয়ে। তিনি জানান, আমার পেইজের নাম ‘মধুশৈলী’। ২০১৭ থেকে কাজ করলেও এই করোনার সময়ে অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে। আগে আশেপাশের অনেকেই প্রোডাক্ট দেখতে বাসায় চলে আসতেন কিন্তু এখন তারা অনলাইনে দেখছেন। তারা এভাবে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছেন নিজের অজান্তের তা ই-কমার্সের জন্য ভালো দিক। করোনাকালে আমার ব্যবসা ভাল হচ্ছে।
এই করোনাকালেই “দ্যা লাঞ্চবক্স” পেইজ খুলে ব্যবসা শুরু করেন হুমায়রা তাবাসসুম। তিনি বলেন, আমি শখে খুলেছিলাম, কিন্তু এত সাড়া পাবো তা ভাবিনি। হয়তো সব কিছু বন্ধ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে মানুষ ঘরের খাবারে বেশী আগ্রহী।
তাদের মত আরও অনেকেই এসেছেন নতুন নতুন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় মধু ও ঘি নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন তপন দে। তার পেইজের নামা “লাবণ্যতা”। তিনি বলেন, করোনার এই সংকটকালীন সময়ে মানুষ যাতে ঘরে বসে যেনো প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে যায়, সেই উদ্দেশ্যেই আমার কাজ করা। সাড়াও পেয়েছি ভাল।
রনি পাল ইলিশপ্রেমী নামে একটি পেইজের মাধ্যমে চাদপুরের ইলিশ পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকের ঘরে ঘরে। তিনি বলেন, চাকুরির চেষ্টা করছি প্রায় দেড় বছর যাবত। বাড়ি থেকে আর কত টাকা আনব! তাই চিন্তা করছিলাম বেশ কিছুদিন যাবত অনলাইনে কিছু একটা করে নিজে চলার মতো উপার্জন যদি করতে পারি। সেই থেকেই স্বপ্ন বোনা এবং শেষ পর্যন্ত মাছ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। ইলিশ নিয়ে বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছি।
মজাদার কিছু খাবারের আইটেম নিয়ে করোনাকালে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন সাকেরা সুলতানা শাম্মী। তিনি জানান, আমার পেইজের নাম bake n’ flake । করোনাকালে নতুন কিছু করার চিন্তা থেকেই আমি শুরু করি। যদিও ১৫ বছর ধরে আমি নিজের জন্য এইগুলা তৈরি করতাম, এটা আমার শখ ছিল। শখ থেকেই এখন পেশাদার হওয়ার পথে। বর্তমানে আমাকে সাহায্য করছে আমার নিকট আত্মীয় তামান্না আক্তার। শুরুর ২ মাসে ভাল সাড়া পেয়েছি। প্রত্যাশা ভালো কিছু হবে।
তবে বিষয়ভিত্তিক পেইজগুলোর বিক্রি কমে এসেছে। জুয়েলারী নিয়ে কাজ করছেন ফারহাত আহমেদ ও তার বন্ধু সুবর্না আক্তার। তাদের পেইজের নাম “লীলাবতী”। ফারহাত আহমেদ বলেন, আমাদের বিয়ের গহনাই বেশী বিক্রি হত। কিন্তু করোনার জন্য বিয়ে কমে আসায় অর্ডার আসছে না। প্রথম দিকে একেবারে বন্ধ ছিল কিন্তু বর্তমানে সেই চিত্র বদলেছে, কিছু কিছু অর্ডার আসা শুরু হয়েছে।
ইউকে থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মেকআপ এনে ‘Blush Makeup’ পেইজের মাধ্যমে বিক্রি করছেন তুহিনা চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনার এই দুর্যোগেরকালে মানুষ ঘর থেকে বের হওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। করোনাকালীন সময় অনলাইন কেনাকাটার প্রতি গ্রাহকদের আকর্ষণ চোখের পড়ার মত। অনেক উদ্যোক্তারাও অনলাইনের ব্যবসা করার প্রতি আগ্রহী।
করোনাকালে জন্মদিন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কমে এলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘরোয়াভাবে তা পালন হয়েছে। তবে এই অনুষ্ঠানের জন্য কেক পেতে ভরসা ই-কমার্স। রয়েল কেক পেইজ থেকে করোনাকালে প্রচুর কেক বিক্রি করেছেন জানিয়ে মিথি জামান বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনাকালে চাহিদা বেড়েছে। কারণ মানুষ স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা ভেবে বাইরে থেকে না কেনে হোমমেইড কিনতে বেশি আগ্রহী। তবে আমার ইচ্ছে আছে এই ক্রেতাদের ধরে রাখা। সবাই যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন আমার বিশ্বাস স্বাভাবিক সময়েও তারা পাশে থাকবেন।
ই-কমার্সের সফলতার গল্প মৌলভীবাজারে অনেক। যারা সফল হয়েছেন তাদের একজন তৃষা মমসাদ, তিনি জানান প্রথমে ফেসবুকে পেইজ খুলে শুরু করি এবং ভাল সাড়া পাই। মানুষের সাড়া পেয়ে আমি এখন শহরের সেন্টাল রোডে একটি শো-রুম নিয়েছি। আমার পেইজ এবং শো রুমের নাম ট্রেন্ড ফ্যাশন।
তবে করোনার প্রথম দিকে কুরিয়ার বন্ধ থাকায় কিছুটা সমস্যায় পড়েন ই-কমার্সের উদ্যোক্তারা।
মৌলভীবাজারের চা এবং মনিপুরী শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন ফারহানা জামান। তিনি জানান, আমার পেইজের নাম Story of Tea- চায়ের গল্প। করোনার শুরু পর কুরিয়ার বন্ধ থাকায় প্রথম দিকে ব্যবসা থেমে গিয়েছিল কিন্তু কুরিয়ার চালুর পর আবার আগের মত চলছে। যখন কুরিয়ার বন্ধ ছিল তখন গ্রাহকরা অপেক্ষায় ছিল কখন কুরিয়ার চালু হবে। এটা সম্ভব হয়েছে পণ্যের মান ঠিক রাখার কারণে। আমি ভাল সাড়া পাচ্ছি।
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসা বাড়তি অর্ডারের চাপ সামলাতে হয়েছে লজিস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। দেশের অন্যতম শীর্ষ ডিজিটাল কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ই-কুরিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা এবং চিফ এক্সিলেন্স অফিসার বিপ্লব ঘোষ রাহুল বলেন, ২০১৯ সালের ঈদ আর ২০২০ সালের ঈদের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। আগে থেকেই ই-কমার্সের একটি গ্রাহক শ্রেণি ছিল। এর মাঝেও কিছু কেনাকাটা অফলাইনে হতো, কিছু অনলাইনে। কিন্তু এবার আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ই-কমার্সে যুক্ত হয়েছে এবং বেশিরভাগ কেনাকাটাই শুধু অনলাইনে হয়েছে। ফলে ই-কমার্সগুলোর ওপর যেমন একটি চাপ ছিল, আমাদের উপরও ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ই-কুরিয়ারসহ মোটামুটি সবাই অন্যান্যবারের থেকে তিনগুণ বেশি পণ্যের অর্ডার পেয়েছি এবার। এজন্য আমাদের আগে থেকেই একটা ব্যাক-ক্যালকুলেশন করা ছিল। আমরা ই-কুরিয়ার থেকে ঠিক ততটুকুই অর্ডার নিয়েছি, যতটুকু আমরা দিতে পারি। ২০ মে পর্যন্ত আমরা ই-কমার্সগুলোর থেকে পার্সেল সংগ্রহ করেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে, আরও বেশি লোকবল থাকলে হয়তো আমরা আরও বেশি পণ্য সরবরাহ করতে পারতাম।
Leave a Reply