ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যু কাঁদাচ্ছে হাওরের তলানির উপজেলা সুনামগঞ্জের শাল্লার মানুষকে। এই উপজেলা থেকেই ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এ উপজেলার ৫০টির মতো গ্রামে পুনর্বাসন কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শাল্লার ৮৮ বছর বয়সী রাজনীতিক রামানন্দ দাস বলেন, শাল্লার মানুষ তাকে ‘আবেদ ভাই’ বলেই ডাকত। ব্র্যাকের মাধ্যমে তার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অবহেলিত এই জনপদের মানুষের।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রামানন্দ দাস বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের সময় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা কেবল আমার বাড়িই নয়; ৩৩টি গ্রাম একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। তখন সিপিবির উপজেলা শাখার সভাপতি আমি। একদিন সন্ধ্যায় থানা সদর (ঘুঙ্গিয়ারগাঁও) থেকে নোয়াগাঁওয়ের বাড়ি ফিরছি। সুখলাইন গ্রামের কাছে এলাকার মনোরঞ্জন ডাক্তারসহ আবেদ ভাই ও তার সঙ্গে থাকা আশরাফ নামে একজন পথ আটকালেন। মনোরঞ্জন ডাক্তার আবেদ ভাইকে বললেন, আপনি যাকে খুঁজছেন তিনিই (রামানন্দ দাস)। আবেদ ভাই বললেন, চলুন, আপনার বাড়িতে যাই। আমি বললাম, বাড়ি তো নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে স্কুলঘরে আছি। আমি বললাম, চলুন ঘুঙ্গিয়ারগাঁওয়ে যাই। ওখানে গিয়ে ডাকবাংলোয় উঠলাম। আবেদ ভাই বললেন, পাকিস্তানি হায়েনারা এখানকার মানুষের বাড়িঘরের অনেক ক্ষতি করেছে। কারা কারা গৃহহীন অবস্থায় আছে, একটি জরিপ এক সপ্তাহের মধ্যে চাই। পরদিন আমি কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম। তারা কাজ করতে সম্মত হলেন। আবেদ ভাই তাদের হাতে ৩৫ টাকা তুলে দিলেন। সাত দিনের মধ্যেই শিক্ষকরা আবেদ ভাইয়ের সরবরাহ করা ফরম পূরণ করে দিলেন। আবেদ ভাই জানালেন, ছোট ঘর যাদের, তাদের ১০টি করে টিন এবং বড় ঘর যাদের, ১৫টি টিন দেওয়া হবে। এই সহায়তা কাজ চালানোর জন্য অফিস নেওয়া হলো ঘুঙ্গিয়ারবাজারে (শাল্লা উপজেলা সদর); দিন-তারিখ মনে নেই। সেটি ১৯৭২ সালের দিকে। আবেদ ভাই আমাকে বললেন, অফিসের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি জানালাম, আমি পার্টির (সিপিবি) দায়িত্বে আছি। বরুণ দা’র (কমরেড বরুণ রায়, সাবেক সংসদ সদস্য) অনুমতি নিতে হবে। তিনি আমাকে বরুণ দা’র কাছে নিয়ে গেলেন এবং তার অনুমতিও নিলেন। এই সময়ে অনেক গ্রামেই আবেদ সাহেব নিজে গেছেন। ৩৩টি গ্রামের ছোট বাড়িগুলোতে ১০টি করে টিন এবং বড় বাড়িতে ১৫টি করে টিন এবং নগদ কিছু সহায়তা দেওয়া হলো। মৎস্যজীবীদের জাল-সুতা দেওয়া হলো। গ্রামে গ্রামে সমিতিও গড়ে তোলা হলো। আড়াই বছর পর আমি পার্টির নির্দেশে এই কাজ ছেড়ে দিলাম। এর পর অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ২৩ বছর আগে একদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের (প্রয়াত পার্লামেন্টালিয়ান) অনুরোধে দেখা করতে গিয়েছিলাম তার রাজধানীর অফিসে। আমাকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন। শাল্লার মানুষের জীবন-জীবিকার খবর নিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তার মৃত্যুর খবর শাল্লার মানুষকে শোকে ভাসিয়ে দিয়েছে।
Leave a Reply