ভারতবিরোধী ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে খুন হওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বললেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্।
আজ মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকালে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে ছেলেটা বিকেল ৫টায় ঢাকায় পৌঁছাল, তাকে ৮টার দিকে নির্যাতন করার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। ছয় ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালাল, এটা অবশ্যই পরিকল্পিত।’
আবরারের চাচা বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো নেতার ইন্ধন রয়েছে। কেননা দু-একজন নয়, সেখানে ১৫ জনেরও বেশি ছেলে হত্যায় অংশ নিয়েছে। পরিকল্পিত ছাড়া এতজন কাউকে মারতে পারে না। হাইকমান্ডের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে।’
এর আগে সকাল পৌনে ৮টার দিকে আবরারের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি কুষ্টিয়ার রায়ডাঙ্গা গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এ সময় প্রতিবেশী ও স্বজনদের কাঁদতে দেখা যায়।
এর আগে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আবরারের মরদেহ কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সকাল সাড়ে ৬টায় তার দ্বিতীয় জানাজা হয়। বেলা ১০টার পর আবরারের তৃতীয় জানাজা হবে। এরপর দুপুরে গ্রামের গোরস্থানে দাফন করা হবে।
উল্লেখ্য, সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোর ৪টার দিকে মৃতদেহটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
আবরার ফাহাদ ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলেই থাকতেন। আবরারকে পেটানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুস্তাকিন ফুয়াদকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, রাত ১১টার দিকে আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এর পর তাকে জেরা করতে করতে পেটাতে থাকে নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত সাহা, উপ-দফতর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুজতাবা রাফিদ, সমাজসে বাবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন কর্মী সে দলে ছিলেন।
রহস্যজনক এই মৃত্যুর ৮ ঘণ্টা আগে ভারতকে সমুদ্র বন্দর, পানি ও গ্যাস দেয়ার চুক্তির বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ।
সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোর ৪টার দিকে মৃতদেহটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
গত শনিবার বিকাল সাড়ে ৫ টায় ওই স্ট্যাটাসের পর আজ মধ্যরাতে ফাহাদের মৃত্যুর খবর পায় তার পরিবার।
ওই স্ট্যাটাস আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত ৯ হাজার লাইক ও তিন হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে।
ব্রেকিংনিউজের পাঠকদের জন্য ফেসবুকে দেওয়া আবরারের শেষ স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
‘‘১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।
হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন-
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’’
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন জানান, আজ সোমবার ভোরে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছেন তারা। মধ্য রাতের দিকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবরারের পায়ে এবং হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পুলিশ ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে। হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
বুয়েটের ডাক্তার মাসুক এলাহী বলেন, রাত ৩টার দিকে হলের শিক্ষার্থীরা আমাকে ফোন দেয়। আমি হলে গিয়ে সিঁড়ির পাশে ছেলেটিকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। ততক্ষণে ছেলেটি মারা গেছে।
মৃত ফাহাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা রোডে। বাবার নাম বরকত উল্লাহ। সে বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এবং শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতো।
Leave a Reply