রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার এক মা ও তাঁর ৯ বছরের ছেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৯ জুলাই ভর্তি হন মহাখালীর বেসরকারি ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পরই শিশুটিকে শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-পিসিআইইউ) নেওয়া হয়। গতকাল সকালে শিশুটি মারা গেছে। আর তার মায়ের চিকিৎসা চলছে।
গতকাল বিকেলে ওই হাসপাতালে গিয়ে জানা যায় এমন তথ্য। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, শিশুরা জটিল অবস্থায় আসছে। কেউ আসছে কয়েকটি হাসপাতাল ঘোরার পর। সব রোগীকে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ওই হাসপাতালে পিসিআইইউ শয্যা আছে ১৪টি। সব কটিতেই এখন রোগী আছে। তাই গত সোমবার আসা একজন রোগীকে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি।
গতকাল রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ১০টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা পরিস্থিতি ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর পাঁচজন প্রতিবেদক। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালেই এখন হিমশিম অবস্থা। অন্য রোগীদের পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের রাখা হচ্ছে মেডিসিন বিভাগ থেকে শুরু করে সার্জারি বিভাগেও। কোনো কোনো হাসপাতালে ওয়ার্ডের বিছানায় ও বারান্দাতেও রোগীদের চিকিৎসা চলছে। জরুরি অবস্থায় রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। পার্থক্য এই যে শয্যা না থাকলে বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ভর্তি করে না। আর সরকারি হাসপাতাল কোনো রোগী ফেরত পাঠায় না।
তবে সবচেয়ে বেশিতে ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরা। যেসব হাসপাতালে পিসিআইইউ নেই, তারা শিশুদের ভর্তি নিচ্ছে না বলে জানা গেল। ইবনে সিনা হাসপাতালের উপব্যবস্থাপক (কাস্টমার কেয়ার) মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পিসিআইইউ না থাকায় তাঁরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু ভর্তি করছেন না।
সব ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু রোগী, আছে বারান্দায়ও
ধানমন্ডির ১২/এ সড়কে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি ভবন পাশাপাশি। মূল ভবনের নিচতলায় তথ্যকেন্দ্র। ডেঙ্গু রোগীর তথ্য চাইলে দায়িত্বরত একজন বলেন, পাশের ভবনে গিয়ে দেখেন, সবই ডেঙ্গু রোগী। এটা এবার মহামারি হয়ে গেছে। তাঁর দেখানো পাশের ভবনটি পাঁচতলা। ২য় ও ৫ম তলায় মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড। এখানেই রাখা হয় ডেঙ্গু রোগীদের। কিন্তু রোগীর চাপে প্রতিটি তলার সব ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের। এমনকি সার্জারি বিভাগেও ডেঙ্গু রোগী আছে বলে জানান দায়িত্বরত নার্সরা।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুস সবুর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অনেক রোগী ডেঙ্গু শনাক্তের পরও বহির্বিভাগ থেকে বাসায় চলে যাচ্ছে। বাসা থেকে চিকিৎসা করাচ্ছে।
প্রায় একই চিত্র পাওয়া গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। এ দুটি হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের জন্য কয়েকটি ওয়ার্ড ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতেও চাপ সামলাতে না পেরে অন্য ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রোগী। তাতেও যারা জায়গা পায়নি, তারা আছে বারান্দায়।
রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩২
ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় রোগী
শিশুদের জায়গা হচ্ছে না সব হাসপাতালে
গতকাল সবচেয়ে বেশি ভর্তি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে মোট ৪০৬ জন ভর্তি ছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছিল ১৪৫ জন। ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর কক্ষের ৮টি শয্যার সবাই ছিল ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী। কক্ষের বাইরে বারান্দায় দেখা গেল আরও তিনজন। এই হাসপাতালের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চারটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ড ও বারান্দায় চলছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা। রোগীদের সঙ্গে আছেন স্বজনেরাও। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে চলছে রোগীর পরিচর্যা। হাতপাখা দিয়ে অনেককে বাতাস করতে দেখা গেল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে নার্সদের টেবিলে করণীয় জানতে রোগীর স্বজনদের ভিড় ছিল প্রায় সব সময়ই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য নির্ধারিত শয্যা ৬০। অথচ চিকিৎসাধীন আছে ১৩৩ জন। শয্যা না থাকায় বাড়তি রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য বরাদ্দ আছে ১২টি শয্যা, এখন ভর্তি আছে ৬৫ শিশু।
পুরান ঢাকার সরকারি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি।
হাসপাতালের শিশু বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রোগী বেড়ে যাওয়ায় ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বাইরের বারান্দায় রোগী রাখা হয়েছে।
Leave a Reply