বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন

নোটিশ :
Welcome To Our Website...
‘মিউজিশিয়ান আছে কিন্তু গানে বাণীর অভাব’

‘মিউজিশিয়ান আছে কিন্তু গানে বাণীর অভাব’

বরেণ্য সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। আশির দশকে সংগীতাঙ্গনে পা রাখেন তিনি। উপহার দিয়েছেন অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান। ২১ জুন বিশ্ব সংগীত দিবস। এ উপলক্ষে সংগীতের নানা বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শান্তর সঙ্গে তার কথোপকথনের অংশবিশেষ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—

রাইজিংবিডি: বাংলাদেশের সংগীত কতটা এগিয়েছে বলে মনে করেন?
কুমার বিশ্বজিৎ: এক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি অগ্রসর। এখন প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন। কিন্তু আমরা অতি আধুনিকতার নামে নিজেরটাকে ছোট করে পরেরটা বড় করে দেখি। এই বিষয়টি আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। নিজের সংস্কৃতি সবার উর্ধ্বে রাখতে হবে। কারণ আমাদের মধ্যে উন্নাসিকতা আছে। এক শ্রেণির মানুষ বাংলা গান শোনাকে লজ্জাজনক মনে করেন। আমার ছেলে বাংলা বলতে পারে না, আমার ছেলে বাংলা বোঝে না, আমার ছেলে বাংলায় গায় না— এটা নিয়েও অনেকে গর্ববোধ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, আমাদের শিকড়ের চেয়ে অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি যদি কেউ লালন করে তবে পরাজয়টা কার? বাংলাদেশি পাসপোর্ট সঙ্গে রাখব আর অন্য সংস্কৃতি লালন করব এটা তো হতে পারে না। নিজের শিকড়কে আমরাই যদি উপড়ে ফেলি তবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অন্য সংস্কৃতি ভর করবে। এটা ভঙ্কর। আজকে বিশ্ব সংগীতে আমাদের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে।

আমাদের মতো এত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর কোনো দেশের আছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের আউল-বাউল, সংগীতের মহাজনরা যেভাবে সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেটা লালন করে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। এটা যদি সম্ভব হয় তবে বর্হিবিশ্বে আমাদের চেয়ে বড় আইডেন্টিটি অর্জন আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। আমরা অন্যের সংস্কৃতি যদি লালন করি তাহলে হবে না। কারণ এটা তো ওদের, ওদেরটা যদি আমি আপনি শোনাতে যাই তবে ওরা শুনবে না। কারণ এটা আমাদের চেয়ে ওরা ভালো জানে। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিমুখ হয়ে যাবে। পাশের দেশে রিয়েলিটি শো-গুলোতে দুরবিন শাহর গান, আকরম শাহর গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, হাছন রাজার গান ব্যবহার করে দর্শক টেনে নিচ্ছে। আবার আমরাই সেই গান নিচ্ছি। কিন্তু আমরা আমাদেরটা আগে নিচ্ছি না কেন? বিশ্ব সংগীত দিবসে আমার প্রত্যাশা, আমাদের সংগীত আমরাই লালন করব, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরাই নিয়ে যাব। সারা পৃথিবী সংগীতময় হোক সেই শুভকামনা জানাই।

রাইজিংবিডি: আপনি সিনেমার অনেক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এবং সেগুলো শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। বর্তমান সময়ে সিনেমার গান আগের মতো জমে উঠছে না কেন?
কুমার বিশ্বজিৎ: এটা পরিচয়ের সংকট। নিজের আইডেন্টিটি যখন হারিয়ে যাবে তখন কোনো জিনিস মনে ঢুকবে না। বাঙালি হিসেবে আমার কিছু মূল্যবোধ আছে। আমরা একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান। যদিও এখন বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই। কিন্তু এটা আমাদের সংস্কৃতি না। যখন একটি সংস্কৃতিতে অন্য সংস্কৃতি ভর করে, নিজের মূল থেকে যখন বিচ্যুত হয়ে যায় তখন মানুষের ভালো লাগার বিষয়টি কাজ করে না। এখনো দেশের বাইরে গেলে কথা বলার জন্য একজন বাঙালি খুঁজি। এটা কেন করি? কারণ এটা আমাদের অস্তিত্ব। এখনো ঈদ বা পার্বণে কেন আমরা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাই? কারণ হলো— বন্ধনের টান। এটাই হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধের বাইরে গেলেই শিকড় ছিঁড়ে যায়। শিকড়ের মধ্যে থাকলে হৃদয় স্পর্শ করবে। যেকোনো দেশের সংগীতকে লালন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে গান শোনাটা বিনোদন হয়ে গেছে। বলতে পারেন এক ধরণের বিলাসিতা। অর্থনৈতিক কারণে এই শ্রেণির মানুষকে দুটো চাকরি করতে হয়। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার জন্য পাঁচটি গৃহ শিক্ষক রাখতে হয়। যার কারণে গান শোনাটা তাদের এক প্রকার বিলাসিতা হয়ে গেছে। সিনেমা দেখার জন্য ভালো হল নাই, তাছাড়া এগুলো দেখার যে প্র্যাকটিস সেটা চলে গেছে। এখন সবাই তো ইউটিউব বা অনলাইল বেইজ না। আমার মা তো অনলাইনে যাবে না। আমার দাদা-দিদি অনলাইনে যাবে না। অনলাইনে এক শ্রণির মানুষ যায়, আরেক শ্রেণির উন্নাসিকতা- বাংলা গান শুনি না। এরকম অনেকগুলো ভাগ হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েকে অনলাইনে গান শোনার জন্য ফোন দেব সেখানেও ভয়। গান শুনতে গিয়ে তারা আবার কী শোনে তা নিয়ে চিন্তা আছে। এই শ্রেণি বিভাজন থেকেই কিন্তু শ্রোতা কমে যাওয়া। আমাদের সমৃদ্ধ হওয়ার চেয়ে চটকধারী হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে কীভাবে আমার ভিউয়ার্স বাড়াবো সেই চিন্তায় এখন সবাই ব্যস্ত। কিন্তু সেটা দিয়ে তো মানদণ্ড হয় না। মানদণ্ড বিষয়টি বজায় রাখতে হবে। নিজের স্বার্থের জন্য সবাই যদি অস্তিত্ব বিলিয়ে দিই তখন কালচারের গভীরতা থাকে না।

রাইজিংবিডি: ইউটিউবে ভিউয়ের উপর নির্ভর করে গান বিচার করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে…
কুমার বিশ্বজিৎ: গান দেখার বিষয় না, উপলব্ধির বিষয়। চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে হয়। একটি গানের ভিডিওতে যতটা লাইক হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ভিউ হচ্ছে। কিছু জিনিস উৎসুক হয়ে দেখতেই পারি। এই দেখাটাকে তো মানদণ্ড বলতে পারি না। কারণ মানুষ ভালো জিনিসও দেখে, আবার খারাপ জিনিসও দেখে। অনলাইনে কীভাবে ভিউয়ার্স বাড়ানো যায় সেগুলো হয়তো সাধারণ মানুষ জানে না। আসলে এখানে টেকনিক্যাল অনেক বিষয় আছে। আমার মনে হয় না এই মূল্যায়নটা সব ক্ষেত্রে সঠিক।

কালচারালি কতটুকু অংশগ্রহণ করব, আমাদের সংস্কৃতিকে কতটুকু সমৃদ্ধ করব, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাব, যা যুগের পর যুগ টিকে থাকবে— এসব বিষয়ে প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের কমিটমেন্ট থাকা উচিত। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে সবারই একটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আমি লক্ষাধিক গান গাইলাম কিন্তু পাঁচটি গানও টিকল না তাতে লাভ কী? চটকধারী জিনিস বেশি দিন টিকে না। এজন্য যারা এগুলো করছে তাদেরকে একসময় হতাশায় ভুগতে হবে। একসময় তারা ভাববে, কিসের পিছনে দৌড়েছি। অনুশোচনা কিন্তু আরো বেশি মারাত্মক। সাময়িক শান্তি ভবিষ্যতে অনেক বেশি অনুশোচনার বিষয় হবে। আমি আমার ভাবনা থেকে বলছি, একটি ভালো গান কেউ শুনল না, দেখল না, তারপরও নিজের একটা প্রশান্তি আছে। আমার দশ লাখ অযোগ্য শ্রোতার চেয়ে এক লাখ যোগ্য শ্রোতা ভালো। যোগ্য বলতে বুঝাচ্ছি, যারা সত্যিকার অর্থে ভালোকে ভালো বলেন, ভালো জিনিসকে ভালোবাসতে জানেন। যার মধ্যে সাহিত্য আছে, কাব্য আছে, গভীরতা আছে, অন্ত্যমিল আছে। যেখানে অনেক বেশি উপলব্ধির বিষয় আছে। যেটা আমি চোখ বন্ধ করে শুনব, যেটা আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দেবে, কল্পনায় চলে যাব। আমার তেমন ভিডিও দেখার দরকার নেই। বরং গান শুনে অন্তরের ভেতরে ভিডিও বানাব। একেক জনের কাছে একেক রকম ভিডিও তৈরি হবে। যখন এটা হবে তখন সেটা গান হবে! কিন্তু ভিডিও তৈরি করে আগেই সেই কল্পনার দরজা বন্ধ করা হচ্ছে। যার জন্য গানের স্থায়ীত্ব কম।

অনেক ফাংশনে দেখেছি, অনেক জুনিয়র শিল্পী মন্তব্য করেন— ‘ওনার সঙ্গে উনি জমিয়েছে ভালো।’ অনেকে আবার বলে, ‘ভাই, এই গান খাবে না।’ আরে ভাই, গান কি জমানোর জিনিস? গান কি খাওয়ানোর জিনিস? নাকি গান উপলব্ধির জিনিস? বিষয়টি খুব খারাপ লাগে। যাই হোক, পৃথিবীতে পরিবর্তনের একটা সময় যায়। এটা ১০/২০ বছরে আসে। আবার সেটা ঠিক জায়গায় ফিরেও আসে। এজন্য সময়কে সময় দিতে হবে।

রাইজিংবিডি: ব্যান্ড সংগীতের একাল-সেকাল নিয়ে কিছু বলুন…
কুমার বিশ্বজিৎ: আমি সংগীতকে সার্বিক অর্থে দেখব। কেউ হয়তো পাঁচজন কিংবা বিশজন নিয়ে দল গঠন করেছেন। কিন্তু সংগীতটা হলো প্রধান। ৮০-৯০ দশক কিংবা তার পরে দেশে ব্যান্ড সংগীতের যে বিবর্তন সেটা চমৎকার ছিল। এখন যে সেই ধারাবাহিকতা নেই তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্পীর অভাব, গীতিকবির অভাব। কিন্তু চমৎকার মিউজিশিয়ান তৈরি হচ্ছে অথচ গানে বাণীর অভাব রয়েছে। গানে বাণী বিশেষ ভূমিকা রাখে। আগে গানের কথা, তারপর সুর, তারপর গায়কি, তারপর কম্পোজিশন। সংগীত এমন একটি বিষয় যেখানে প্রতিটি বিষয় রয়েছে। যেমন: এখানে গণিত আছে। কোনটা কতটুকু করতে হবে, কোনটা না করলে কী হবে, কোনটা করলে ক্ষতি বা লাভ কতটুকু হবে তা জানতে হবে। এটাই গণিত। রসায়ন জানতে হবে। ফিজিক্স জানতে হবে। গান গাইতে হলে আপনাকে শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হবে। গান হচ্ছে ফুসফুস ও দমের খেলা। এজন্য আপনাকে শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হবে।

আমি একটি দেশের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছি। সুতরাং ব্যক্তি লাভের চেয়ে আমি আমার সংস্কৃতি ও শিকড়কে সবার উর্ধ্বে রাখব। আমাদের এমন কিছু রেখে যেতে হবে যা থেকে পরবর্তী প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারে এবং গর্ববোধ করতে পারে— পূর্বপুরুষ আমাদের জন্য এই দিয়ে গেছেন। এটা না হলে সংস্কৃতি আগাবে না। শুধু কিছু প্রোডাকশন হাউজের লাভ হবে। যাদের কাছে সংগীত হচ্ছে ব্যবসা। আমি অনেকগুলো কাজ করেছি স্রোতের বিপরীতে। আমি গানের কথা, সুর কোনো কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করিনি। তখন প্রোডাকশন হাউজের মালিকরা বলতেন, ‘ভাই এগুলো চলব না।’ আমার চলার দরকার নাই। কারণ আমি সংগীতকে শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিনি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আর্কাইভ

June 2019
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

Weather

booked.net




© All Rights Reserved – 2019-2021
Design BY positiveit.us
usbdnews24