‘দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা’ প্রবাদটি আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেও (চমেক) সাপ পোষা শুরু হয়েছে। হাত দিয়ে খাবার খাইয়ে দেয়া হচ্ছে বাচ্চা সাপদের। এমন আদর যত্নে সাপগুলো পোষা হচ্ছে দেশের চিকিৎসা খাতের কল্যাণে। এদের বিষ দিয়েই তৈরি হবে সাপে কাটা রোগীদের জন্য প্রতিষেধক।
এটি মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রকল্প। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে।
২০১৮ সালে সাপের দংশনের ঘটনাকে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার’ হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের তথ্যমতে, প্রতিবছর ৮১ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, যার প্রায় অর্ধেক মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে ভারতে। বাংলাদেশে বছরে এই সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এরমধ্যে অনেকেই সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা যান।
দেশে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় ভারতে তৈরি প্রতিষেধক। অ্যান্টিভেনমগুলো মূলত ভারতীয় সাপের বিষ থেকেই তৈরি হয়। তবে গত মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে বলা হয়, যে অঞ্চলের সাপ মানুষকে দংশন করে, তাদের চিকিৎসায় সেই অঞ্চলের সাপের বিষ দিয়ে বানানো প্রতিষেধক সবচেয়ে কার্যকর। তাই বাংলাদেশে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরি করার পরিকল্পনা নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বর্তমানে বাচ্চাসহ ৬১টি বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। এগুলো থেকে ইতোমধ্যে ভেনমও সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমানে সেগুলোর উপর গবেষণা চলছে উল্লেখ করে চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, এখনো সাপ সংগ্রহ করার কাজ চলছে। সাপগুলো সংগ্রহ করে সেগুলোর ভেনম নিয়ে গবেষণা করা হবে। ইতোমধ্যে অল্প পরিসরে তা শুরু হয়েছে। তারপর সেই ভেনম থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হবে। আমরা সে অনুযায়ী এগোচ্ছি।
যে ঘরটিতে সাপগুলো যত্নসহকারে পোষা হচ্ছে সেটা খুবই সুরক্ষিত। একাডেমিক ভবনের নিচতলার একটি মিলনায়তনের একপাশ সাপে লালিত হচ্ছে সাপগুলো। গোখরা, কালকেউটে, শঙ্খিনী, সবুজ বোড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির এই সাপগুলোর ঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের বড় বড় কিছু বাক্সে সাপগুলো রাখা। প্রতিটি বাক্সে একটি করে সাপ। কাছাকাছি যেতেই একটি গোখরা ফণা তুলে ফোঁস করে ওঠে। পাশেই পোষা হচ্ছে ইঁদুর, প্রজননও হচ্ছে এখানে। তাদেরকেও দেয়া হচ্ছে ভালো ভালো খাবার। খেয়ে বেশ মোটাতাজা হচ্ছে ইঁদুরগুলো। তারা তৈরি হচ্ছে সাপের মুখে যাওয়ার জন্য!
মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাপের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, আলো-বাতাসের জন্য সাপগুলোকে মাঝেমধ্যে বাক্স থেকে বের করে বড় খাঁচায় রাখা হয়। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সব করছি। তাদের প্রতিনিধিরা নিয়মিত এসে প্রকল্পের কাজ পরীক্ষাও করছেন।
এই প্রকল্পের কাজে যুক্ত আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা মো.মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত মে মাসে সংরক্ষণ করা বিষধর সাপগুলো থেকে ভেনম সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে খুবই কম পরিমাণে ভেনম পাওয়া গেছে সাপগুলো থেকে। ভেনম প্রদান সাধারণত নির্ভর করে সাপের মুড, আবহাওয়া, পরিবেশ এবং খাবারের উপর। চূড়ান্তভাবে অ্যান্টিভেনম তৈরিতে আরো কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহম্মদ আলী রেজা খানের ‘বাংলাদেশের সাপ’ বই অনুসারে এ দেশে সাপের প্রজাতি ৮১ বা তারও কিছু বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর। এদের বিষ মানুষের জন্য মারাত্মক। সাপে কাটা রোগীদের জন্য এ সাপগুলোর অ্যান্টিভেনম সবচেয়ে কার্যকর হবে।
Leave a Reply