।। মিলন আশরাফ ।।
জনপ্রিয়তায় ক্রিকেট খেলার অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের উন্মাদনার শেষ নেই। কবিতা, সিনেমা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, তথ্যচিত্র, চিত্রকলা সবখানেই ক্রিকেটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। লিখিত ফিচারটিতে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে তিনটি বিখ্যাত চিত্রকলার পরিচয় তুলে ধরা হলো:
‘দি ক্রিকেটারস’ চিত্রটি ১৯৪৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান শিল্পী রাসেল ড্রাসডেলের আঁকা। পেইন্টিংটিতে তিনটি বালককে ফাঁকা শহরের ভবনগুলোর মধ্যে দেখা যায়। দুজন খেলছে, একজন দাঁড়িয়ে দেখছে। ‘দি ন্যাশনাল গ্যালারি অব অস্ট্রেলিয়া’ চিত্রটির বর্ণনায় বলে: ‘অস্ট্রেলিয়ান মূল শিল্পে ছবিটি অন্যতম প্রধান ও উল্লেখযোগ্য।’ অস্ট্রেলিয়ার বহু পুরনো দৈনিক ‘দি সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ সাক্ষ্য দেয় যে- ‘সম্ভবত বিশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম এটি।’
চিত্রকলাটির প্রেক্ষাপট: ইংরেজ প্রকাশক ওয়াল্টার হাচিনসনের নিজস্ব সংগ্রহে ছবিটি পাওয়া যায়। ‘ন্যাশনাল কালেকশন অব ব্রিটিশ স্পোর্টস অ্যান্ড পাস্টটাইমস’ নামে তাঁর একটি নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকেই মূলত চিত্রটি আবিষ্কার করা হয়। জানা যায়, হাচিনসন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচের একটি ছবি খুঁজছিলেন। তিনি মেলবোর্ন অফিসের এক কর্মকর্তাকে একজন বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান আর্টিস্টের কাছে তার উদ্দেশ্যের কথা জানাতে বলেন। হাচিনসনের জন্য প্রায়ই কাজ করতেন এমন একজন শিল্প বিক্রেতা লিওনার্ড ভস স্মিথ। তিনি বিষয়টি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ড্রাসডেলের সঙ্গে আলাপ করেন। তিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের সেন্ট্রাল ওয়েস্ট অঞ্চলের হিল এন্ড শহরে থাকতেন। ড্রাসডেল ১৫০ পাউন্ডের বিনিময়ে চিত্রটি আঁকতে রাজি হন। আঁকা শেষ হলে ভস স্মিথ ইংল্যান্ডে হাচিনসনের কাছে সেটি পাঠিয়ে দেন। ছবিটি দেখে হাচিনসন হতভম্ব হয়ে গেলেন। কারণ তিনি যা ধারণা করেছিলেন তার কিছুই নেই ছবিটিতে। তিনি স্মিথের উপর প্রচণ্ড রেগে মেলবোর্নে টেলিগ্রাম পাঠালেন। পরের দিন পুনরায় তিনি ভেবে দেখলেন, ড্রাসডেল বিখ্যাত শিল্পী। তাঁর সম্মানের কথা ভেবে তিনি ভস স্মিথের উপর রাগ কমালেন। ২০০৪ সালে চিত্রটির দাম ওঠে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে চিত্রটি মেলবোর্নভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা ডেজিএল ইনভেস্টমেন্টসের মালিকানাধীন। ১৯৯৮ সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হয়।
চিত্রকর্মটির শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করে ‘দি সিডনি মর্নিং হ্যারল্ড’ লেখে: ‘ড্রাসডেলের বৃহৎ কম্পজিশনে আঁকা ক্রিকেটারস ছবিটি জাগ্রত রশ্মির নিচে বিস্তৃত খোলা জায়গায় নাটকীয় দৃশ্যের জন্ম দেয়। এরকম নাটকীয়তা পূর্বের কোনো ছবিতে দেখা যায়নি।’ দি ন্যাশনাল গ্যালারি অব অস্ট্রেলিয়া দাবি করে, বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে চিত্রকর্মটি শিল্প হিসেবে সফল হয়েছে। ছবিটিতে ব্যাটসম্যানের মডেল টেডি উলার্ড এবং বোলার হিসেবে ছিলেন রয় হোলাইয়ে। ১৯৯৬ সালে মডেলদের সনাক্ত করা হয়। এরপর উলার্ডকে ছবিটি সম্পর্কে বলতে বললে তিনি জানান, ‘আমি শুধুমাত্র ছবিটির মূল্য নির্ধারণ করবো না… এটা আমাদের অনুপাতকেও খুঁজে বের করে তোলে।
পেইন্টিংয়ে দি টাউন অব হিল এন্ডকে যেরকম নির্জন দেখানো হয়েছে সেরকম নয়। পর্যটকরা পরবর্তী সময়ে যখন এটা দেখেছেন তারা এমন মন্তব্য করেছেন। এমনকি চিত্রকর্মটিতে ভবনগুলোকে যেরকম ছড়ানো ছিটানো, মধ্যে ফাঁকা ও মর্মস্পর্শী দেখানো হয়েছে বাস্তবেও তেমনটি নয়। এটা দেখলে মনে হয় যেন চকোলেট বাক্সের ঢাকনার ভেতর থেকে ছিঁড়ে বের হচ্ছে।
কেন্ট বনাম ল্যাঙ্কাশায়ার, ক্যান্টারবেরিকেন্ট বনাম ল্যাঙ্কাশায়ার, ক্যান্টারবেরি
কেন্ট বনাম ল্যাঙ্কাশায়ার, ক্যান্টারবেরি শিরোনামে অঙ্কিত তৈলচিত্রটি আঁকেন অ্যালবার্ট চেভেলিয়ার টেইলর। সাল ১৯০৭। এটি কেন্ট কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের চেয়ারম্যান লর্ড হ্যারিসের পরামর্শে আঁকা হয়। প্রথম কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জয় উদযাপনে ছবিটির উদ্বোধন হয়। টেইলর প্রতিটি কেন্ট খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাদা আলাদা বসার পর ছবিটি আঁকেন। স্বল্পমেয়াদী ঋণে চিত্রটি ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্ট লরেন্স গ্রাউন্ডে ছিল। কেন্ট ক্লাব বীমা সংক্রান্ত জটিলতায় ছবিটি লর্ড প্যাভিলিয়নে স্থানান্তরিত করে। এরপর ২০০৬ সালে একটি দাতব্য ফাউন্ডেশনে নিলামে কেন্ট ক্লাব এটি বিক্রি করে।
চিত্রকলাটির প্রেক্ষাপট: কেন্ট কাউন্টি ক্লাব ১৯০৬ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতে। পুরো ম্যাচে তারা ৭৮ শতাংশ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্লাব অর্জন করেছিল ৭০ শতাংশ পয়েন্ট। ১৮৯০ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কেন্টের এটা প্রথম জয় ছিল। লন্ডনে এক ভোজসভায় কেন্ট চেয়ারম্যান জর্জ হ্যারিস, বেরন হ্যারিস (৪র্থ) ক্লাবটির বিজয় উদযাপন করার জন্য একটি চিত্র আঁকার আয়োজন করতে পরামর্শ দেন। কেন্ট ক্লাব আলবার্ট চেভেলিয়ার টেইলরকে আর্টিস্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়। এর আগে টেইলর লর্ড হ্যারিসের ব্যাটিংয়ের একটি ছবি আঁকেন ১৯০৫ সালে। সম্মানী হিসেবে টেইলরকে ২০০ গিনিস (গোল্ড কয়েন) দিতে সম্মত হন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সম্মানী হিসেবে সেটা দাঁড়ায় ৩৫০ গিনিতে।
ছবিটির আঁকার প্রাক্কালে লর্ড হ্যারিস পরামর্শ দেন চিত্রকলাটিতে সেন্ট লরেন্স গ্রাউন্ডের একটি ম্যাচের অ্যাকশন শর্ট দেখানো উচিত। আর বোলার হিসেবে থাকবে কেন্টের কলিন ব্লিথ। ১৯০৬ সালের সেশনে কেন্ট মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলেছিল ক্যান্টারবেরিতে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ল্যাঙ্কাশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের বিপরীতে যে ম্যাচটি খেলা হয়েছিল ওই ম্যাচের ছবিটিই আঁকা হবে। ওই ম্যাচটিতে ব্লিথ ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। সুতরাং তিনটি ম্যাচের মধ্যে ওই ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ। টেইলর সিদ্ধান্ত নেন দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্নভোজের একঘণ্টা আগের দৃশ্যটি আঁকবেন।
চিত্রটিতে ন্যাকিংটন রোডের সীমানা হয়ে সেন্ট লরেন্স গ্রাউন্ডের শেষ সীমা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। পেছনে দৃশ্যমান ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রাল। ছবিটিতে দেখা যায় প্যাভিলিয়নের শেষ থেকে ব্লিথ বল করতে ছুটে আসছেন, অপর প্রান্তে ব্যাটসম্যান জনি টেলসলি। টেইলর খেলার মাঠের দৃশ্যটিকে সংকুচিত করেছিলেন যাতে কেন্টের এগারো জন খেলোয়াড়কে স্বীকৃতি ও যথাযথ আকার দিতে পারেন।
নির্ভুল আঁকতে টেইলর কেন্ট টিমের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে আলাপ করে নিয়েছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন চিত্রটিতে প্রত্যেকের জীবনের সত্যটাকে উপস্থাপন করতে। টেইলর প্রথমে পরিকল্পনা করেছিলেন নন-স্ট্রাইকিংয়ে থাকা ল্যাঙ্কাশায়ার ব্যাটসম্যান হ্যারি ম্যাকপেইসকে অন্তর্ভুক্ত করবেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার সাথে বসতে না পারায় তিনি অন্য ল্যাঙ্কাশায়ার ব্যাটসম্যান উইলিয়াম ফিনডেলেকে ব্যবহার করেন। তবে ওই ম্যাচে ফিনডেল খেলেননি। কিন্তু সে টেইলরের লন্ডন স্টুডিওতে উপস্থিত থেকে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। কারণ ১৯০৬ সালের শেষের দিকে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের নতুন সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।
প্রদর্শনের ইতিহাস: টেইলর ১৯০৭ সালের মধ্যে ছবিটি আঁকা সম্পন্ন করেন। এই সময়ের ভেতর কর্তৃপক্ষের মতানুসারে তিনি ১৯২টি অগ্রিম খোদাই করেন। এই কাজের জন্য তিনি যথাযথ ক্ষতিপূরণও পান। যখন পেইন্টিংটি উন্মোচিত হয় তখন এর আলো ও ছায়ার সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রশংসিত হয়। ১৯০৮ সালে টেইলর ও লর্ড হ্যারিসের স্বাক্ষরিত অল্পসংখ্যক ছবি মুদ্রণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ ও ২০০০ সালের ভেতর কেন্ট ক্লাব কর্তৃক আরো মুদ্রণ করা হয়। সেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের স্বাক্ষর ছিল। যার মধ্যে কলিন কাউড্রে, ই. ডাব্লুউ সোয়ান্টন, লেস আমেস ও ম্যাথু ফ্লেমিং উল্লেখযোগ্য। ফলে ছবিটির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। রেক্টরি ফিল্ড, ব্লাকহিথ ও লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয় চিত্রটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ভিক্টোরিয়ান ও এডওয়ার্ডিয়ান সময়ে ক্রিকেটের সূবর্ণযুগের উল্লেখযোগ্য চিত্র এটি। ক্রিকেটভক্ত ও ইতিহাসবিদদের কাছে চিত্রটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ই. ডাব্লুউ সোয়ানটন চিত্রটির প্রশংসা করে বলেন, ‘ক্রিকেটারদের খেলার সনাক্তযোগ্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অপ্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রকর্ম এটি।’
চিত্রটি মূলত সেন্ট লরেন্স গ্রাউন্ডের প্যাভিলিয়নে প্রদর্শিত ছিল। তবে ১৯৯৯ সালে কেন্ট বীমাবহন করতে অক্ষম হলে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) কে দেওয়া হয়েছিল চিত্রটি। এমসিসি চিত্রটি লর্ডস প্যাভিলিয়নে ঝুলিয়ে রাখে। ওদিকে কেন্ট সেন্ট লরেন্স গ্রাউন্ডের মূল স্থানে ছবিটির আরেকটি কপি প্রদর্শন করে। ২০০৫ সালে কেন্ট চিত্রটি বিক্রয়ের অভিপ্রায় দেখালে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। কেন্ট সদস্
Leave a Reply